একজন সানাউল্লাহ মিয়ার আত্মত্যাগ হিমালয় চাপা কষ্ট নিয়ে বিদায় হওয়া
|| অলিউল্লাহ নোমান ||
অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে দুনিয়া ত্যাগ করেছেন ৩ বছর হয়ে গেল। দেখতে দেখতে সময় চলে যায়। মনে হচ্ছে, এই তো সেদিন হাসপাতালে ছিলেন। তাঁর সাথে ফোনে কথা হল মাত্র ক’দিন আগে। কিন্তু না, ৩ বছর হয়ে গেছে।
অসুস্থ হওয়ার পর কয়েক দফা কথা হয়েছিল তাঁর সাথে। ফোনের দীর্ঘশ্বাস ও বুকফাঁটা কান্নার অনুভূতি এখনো কানে বাঁজে।
গানাউল্লাহ মিয়া স্ট্রোক করেছেন শুনে একটি দীর্ঘ স্ট্যাটাস লিখেছিলাম। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর হয়ত কেউ তাঁকে সেটা দেখিয়েছিলেন। অ্যাডভোকেট মাসুদ তালুকদার ভাই সেদিন হাসপাতালে ছিলেন। ফোনে আমাকে বললেন, সানা ভাইয়ের সাথে কথা বলেন। ফোনটা কানে নেওয়া মাত্রই দীর্ঘ একটি নি:শ্বাস ছেড়ে বলেছিলেন, সবই তো শেষ ভাই। লিখে আর কি হবে!
তাঁর এই দু’ই লাইনের মধ্যেই বুঝেছিলাম কতটা বুকচাপা কষ্টে আছেন তিনি।
সানাউল্লাহ মিয়ার সাথে সম্পর্ক ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর তাঁকে একবার গ্রেফতার করা হয়েছিল। কারাগারেও ছিলেন অনেক দিন।
সম্ভবত ২০০০ সালে তিনি ঢাকা আইনজীবী সমিতির সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিল। তখন অনেকটা তরুণ সানাউল্লাহ মিয়া। ঢাকা আইনজীবী সমিতিতে ব্যাপক জনপ্রিয় ব্যক্তি। আমি তখন দৈনিক ইনকিলাবে কাজ করতাম। সেই সুবাদে তাঁর সাথে পরিচয়। এরপর থেকে দিনে দিনে সম্পর্কের গভীরতা বেড়েছে। একেবারে কাছে থেকে দেখেছিল দেশ ও জাতীয়তাবাদের জন্য নিবেদিত একজন মানুষকে।
২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বে চার দলীয় জোট ক্ষমতায় এসেছিল। সানাউল্লাহ মিয়া কোর্টে পিপি হতে পারতেন। কিন্তু সরকারি কোন পদ তিনি নেন নি। সাধারণ আইনজীবী হিসাবেই সেবা দিয়ে গেলেন।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারী জরুরী আইনের সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। সরকারি পদবি নিয়ে যারা পিপি-জিপি হয়েছিলেন তারা হারিয়ে গেলেন। তাদের কাউকে সামনের কাতারে দেখা যায়নি। এমন কি খুঁজেও হয়ত পাওয়া যায়নি তাদের। কিন্তু সানাউল্লাহ মিয়ার নেতৃত্বে মাসুদ আহমদ তালুকদার এবং খোরশেদ আলমরা এগিয়ে আসলেন। দলীয় নেতা-কর্মী হলেই হল। কিসের ছুটির দিন, আর কিসের রাত। সানাউল্লাহ মিয়া তাঁর টিম নিয়ে আদালতে হাজির। এজন্য কেই তাঁকে ডেকেছেন বা টাকা পয়সা দিয়েছেন বলে জানা নেই। তবে সানাউল্লাহ মিয়াকে দেখেছি আদালতে নি:স্বার্থভাবে কাজ করতে।
১/১১-এর পর আওয়ামী ফ্যাসিবাদের জামানা। মামলার সংখ্যা বাড়তেই থাকলো। আমার দেশ-এর বিরুদ্ধেও মামলা শুরু হল। সানাউল্লাহ মিয়াই আমাদের আইনজীবী। এতে সম্পর্কের গভীরতা বাড়তে থাকলো। কাঁছে থেকে দেখলাম কেউ চাইলে কিভাবে নি:স্বার্থভাবে সেবা দিতে পারেন। অনেক কিছুই শেখার আছে সানাউল্লাহ মিয়ার নিকট থেকে।
২০১০ সালের ১ জুন আমার দেশ সম্পাদক শ্রদ্ধেয় মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে ফ্যাসিবাদি সরকার। তখন ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে আমাদের আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া ও তাঁর টিম। আমাদের মামলার সংখ্যা বাড়তেই থাকল। প্রতি সপ্তাহে হাজিরা দিতে যেতে হয়। সানাউল্লাহ মিয়ার চেম্বারে সম্পাদক মহোদয়কে নিয়ে হাজির হই প্রতি সপ্তাহে সকাল ৯টার আগে। প্রতিদিন দেখতাম তাঁর চেম্বারে মানুষ গিজগিজ করছে। সবাই এসেছেন হাজিরা দিতে। বড় বড় নেতারাও আসেন মাঝে মধ্যেই একটা কাজ কোর্টে হাজিরা দেওয়া।
রসিকতা করে একদিন সানাউল্লাহ মিয়ার চেম্বারের একজন জুনিয়রকে বলেছিলাম হাজিরার আসামী দেখে তো মনে হচ্ছে কামাই ভালই হয়। উত্তরে বলেছিলেন, হাজিরার জন্য যে ফরমটি ক্রয় করতে হয়, সেটাও নিজের পকেট থেকে দেন সানাউল্লাহ মিয়া। দলীয় লোকদের মামলায় কেউ তাঁকে টাকা দেয় না। তিনিও কারো কাছে চেয়ে টাকা নেন না। এমন নিবেদিনপ্রাণ আইনজীবী দ্বিতীয়জনকে আমি অন্তত ঢাকায় থাকতে দেখিনি।
তবে হিমালয় সমান কষ্ট নিয়ে সানাউল্লাহ মিয়া দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। ১/১১ এর সময় বেঈমানির কারণে আবদুল মান্নান ভূইয়াকে বিএনপি থেকে বহিস্কার করা হয়। একই এলাকায় সানাউল্লাহ মিয়ার বাড়ি। সঙ্গত কারণেই এই আসনটিতে তিনি নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগলেন। প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার হলেই তিনি চলে যান নরসিংদীর শিবপুরে। পুরো সপ্তাহে যা আয় করেন, সবই সেখানে খরচ করেন তিনি।
একদিন তাঁকে বলেছিলাম, ভাই আপনি যে প্রতি সপ্তাহে এলাকায় যাচ্ছেন আর এই খরচ করতেছেন ভবিষ্যতে মনোনয়ন পাবেন তো? জবাবে তিনি বলেছিলেন ম্যাডাম আমাকে এলাকায় কাজ করতে বলেছেন। ম্যাডাম যেহেতু বলেছেন অবশ্যই মনোনয়ন পাবো। সেই আশা নিয়ে ২০১৮ সালে মনোনয়পত্র কিনেছিলেন। কিন্তু, তাঁর আশায় একেবারে গুড়েবালি ঢেলে দেয় পাশ্ববর্তী এলাকার এক টাকা ওয়ালা। সানাউল্লাহ মিয়ার জায়গায় টাকাওয়ালা মনোনয়ন পেলেন। এতে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন তিনি।
সানাউল্লাহ মিয়ার সাথে শেষ যতবারই কথা হয়েছে, তাঁর দু:খ ছিল একটাই। মমোনয়ন দেয় নাই তাতে কোন আফসোস নেই। তবে একটা জায়গায় তাঁর কষ্ট ছিল। তাঁকে কেউ মুখ দিয়ে বলেওনি মনোনয়নটা দিতে পারলাম না। বা এই কারণে আপনাকে দেওয়া গেল না। এমন কোন বাক্য তিনি কারো নিকট থেকে শুনেন নাই। স্রেফ টয়লেট পেপারের মতাই তাঁকে ছুড়ে ফেলা হল। এই ছিল সানাউল্লাহ মিয়ার কষ্ট। তাঁর সাথে কথা বলার সময় মনে হত এই কষ্টের দীর্ঘ নি:শ্বাস যেন হিমালয় চাপা বুক থেকে বের হচ্ছে।
আল্লাহ সানাউল্লাহ মিয়ার নি:স্বার্থ ত্যাগ কবুল করুন। আখেরাতে তাঁকে বেহেস্তে রাখুন।
লেখক: বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট – দৈনিক আমার দেশ