ক্ষমতার দাপটে বেসামাল আমলাতন্ত্র
ড. ফরিদুল আলম
দুটি ঘটনা সারা দেশে আলোচনার ঝড় তুলেছে। বারবার মনের মাঝে একটি প্রশ্ন আসছে, এই ঘটনা দুটি যদি আমাদের আমলাতন্ত্রের একটা খণ্ডিত উদাহরণও হয়ে থাকে তাহলে সরকারি কর্মচারীরা, আসলে দেশ এবং দেশের মানুষকে কতটুকু সেবা করার যোগ্যতা রাখেন? ঘটনা দুটির সাথে একজন অতিরিক্ত জেলা জজ এবং একজন জেলা প্রশাসক সম্পৃক্ত।
প্রথম ঘটনাটি বগুড়ার। একজন অতরিক্ত জেলা এবং দায়রা জজের মেয়েকে স্কুলের নিয়মিত ব্যবহারিক শিক্ষণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে শ্রেণিকক্ষ পরিষ্কার করতে বলা হলে সে তা প্রত্যাখ্যান করে। যুক্তি হচ্ছে সে একজন বিচারকের কন্যা। অহংকার কিংবা দাম্ভিকতায় সেই বিচারককন্যা-সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সহপাঠীদের বস্তির মেয়ে বলেও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে।
এই হলো একজন মেয়েকে তার মা ও বিচারিক কর্মকতার দেয়া শিক্ষা! ছাত্রীটির এহেন বক্তব্যে অপর সহপাঠীরা ক্ষুব্ধ মন্তব্য করলে ক্ষমতাধর জজ মা পরদিন স্কুলে গিয়ে প্রধান শিক্ষককে দিয়ে চারজন অভিভাবককে স্কুলে ডাকিয়ে এনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তাদের জেলে পাঠানোর হুমকি দিলে এদের মধ্যে দুজন মা সেই জজের পা ধরে ক্ষমা চান। কিন্তু বিষয়টিকে সহজভাবে নিতে পারেনি কোমলমতি অপর শিক্ষার্থীরা। তারা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে, সড়ক অবরোধ করে। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসকের আশ্বাস পেয়ে আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
ইতোমধ্যে সেই জজকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে, তার বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার ভয় দেখিয়েছেন। যাতে তার দায়িত্বপালন নিয়েই নানা প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে।
এ ঘটনার তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে তার বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নিলেও তাকে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। অনেকেই বলছেন, এটি প্রকারান্তরে তার জন্য এক ধরনের সুবিধা দেয়া হয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের বেশিরভাগেরই আগ্রহ থাকে ঢাকায় বদলি হয়ে আসতে। সেক্ষেত্রে তিনি অপরাধ করে সেই সুযোগ পেয়েছেন। মেয়েটিও মফস্বলের পরিবর্তে ঢাকার কোনো নামী স্কুলে পড়ার সুযোগ পাবে। এখানে এটাও যৌক্তিক যে পুরো বিষয়টি তদন্তের মধ্য দিয়ে নিষ্পত্তিযোগ্য। তবে সেই তদন্ত প্রক্রিয়া শেষে দোষী সাব্যস্ত হলে এ ধরনের কর্মচারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হবার নজির কিন্তু খুব বেশি নেই।
দ্বিতীয় ঘটনাটি রংপুরের জেলা প্রশাসককে ঘিরে। বেগর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহযোগী অধ্যাপক একটি স্কুলের বিষয়ে তার কাছে প্রশাসনিক সহযোগিতা চাইতে গিয়ে তাকে কেন স্যার বলে সম্বোধন করলেন না সেটা নিয়ে তিনি ভীষণ চটেছেন। বেচারা জেলা প্রশাসক তিনি হয়তো এক্ষেত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভুলে বসে আছেন; একটি হলো সেই শিক্ষকটি পদমর্যাদায় তার চেয়েও একগ্রেড উপরে, আর দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে একজন সরকারি আমলা তিনি যতই বড় পদের অধিকারী হোননা কেন, তাকে স্যার বলে সম্বোধন করার কোনো বাধ্যবাধকতা আমাদের আইনে নেই। যদ্দূর মনে পড়ে, বিগত পে কমিশনের সুপারিশের আলোকে ‘সরকারি কর্মকর্তা’র স্থলে সব সরকারি বেতনভোগীরা ‘কর্মচারী’ বলে গণ্য হবেন।
বাস্তবে দেখা যায় যে, সব সরকারি বিধিবিধান ভুলে গিয়ে আমাদের সরকারি কর্মচারীরা উপনিবেসিক আমলের মনমানসিকতাকে ধারণ করে চলছেন। ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’ কথাটির আভিধানিক অর্থ ‘জনগণের চাকর’, দেশের জনগণ অনেক উদার বলে তাদের সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করেন না বলে কি এটা তাদের দুর্বলতা বলে গণ্য হবে? তাদের গাড়ি বাড়ি আর সরকারি অবারিত সুবিধা দেয়ার অর্থ হচ্ছে তারা যেন নিরবিচ্ছিন্নভাবে সরকারের সেবাগুলোকে জনগণের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছে দিতে পারেন। আমাদের সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে তো স্পষ্ট করেই বলে দেয়া হয়েছে, ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’, যার অর্থ স্পষ্টভাবেই দাঁড়ায়- জনগণ রাষ্ট্রের মালিক। মালিকের সাথে এ কি আচরণ!
ঘটনা যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন সেটা সারা দেশে সংবাদের শিরোনাম হয়। আমাদের সবার কমবেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে সরকারি কর্মচারীরা মাঠ পর্যায়ে কি দোর্দণ্ড প্রতাপ নিয়ে চলেন। আমার ভাবতে অবাক লাগে ১৫/২০ হাজার বা এর বেশি জনগণের ভোটে নির্বাচিত একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে, ক্ষেত্রবিশেষে তার সন্তানতুল্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ সরকারি কর্মচারীদের স্যার বলে সম্বোধন করতে হয়। আসলে আমাদের দেশের সরকারি চাকরিতে একটু পদ পদবিধারী হলেই স্যার সম্বোধনটি শুনতে কি দুর্নিবার আগ্রহ, অথচ এই একটি সম্বোধনের মধ্য দিয়ে যে সরকারি কর্মচারীদের সাথে জনগণের যোজন যোজন দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায় সে কথা কি আমরা একটিবার ভেবে দেখি? যখন একজন সেবাপ্রার্থী একজন সরকারি চাকুরের কাছে গিয়ে স্যার ডেকে হাত কচলে কথা বলেন, তিনি নিজের অজান্তেই ভুলে বসেন যে, তিনি তার অধিকারের কথাটি বলতে এসেছেন, সহজ কথাটি আর সহজে বলা হয়ে ওঠে না, সহজ কাজটি আর সহজ হয় না, আর দুর্নীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার এটাও একটা অন্যতম কারণ।
কানাডাপ্রবাসী আমার এক বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিল। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানালেন যে কয়েকদিন আগে একটি অনুষ্ঠানে গেলে অপেক্ষারত অনেক মানুষের ভিড়ে তার সামনে এসে একজন তার পরিচয় জানতে চান। পরিচয় পেয়ে নিজের পরিচয়টি দিয়ে বলেন তিনি স্থানীয় এমপি। বন্ধুটি জানালেন যে সেরকম আরেকটি সামাজিক অনুষ্ঠানে স্থানীয় মেয়র এসে তার সাথে নিজ থেকেই সাবলীলভাবে আলাপচারিতা করতে থাকেন। আর সরকারি কর্মচারীদের তো কথাই নেই, সেবা দেবার জন্য সদা প্রস্তুত, অফিস সময়ের মধ্যে বক্তিগত আলাপচারিতা বা ফোনালাপ সেরকমভাবে নিষিদ্ধ না থাকলেও তারা এসব চিন্তাও করতে পারেন না।
উদাহরণগুলো দিলাম এ কারণেই যে সবকিছু আইন-কানুন দিয়ে নির্ধারণ করা যায় না। নিজের মধ্য থেকে যদি তাগিদ কাজ না করে তাহলে কখনও নিজেকে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে দাবি করা যায় না। অভিযুক্ত ব্যক্তিদ্বয়ের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি প্রযোজ্য।
আমাদের সমাজে এ রকম অনেক অসঙ্গতি রয়েছে, তবে উল্লিখিত ব্যক্তিদ্বয়ের ক্ষেত্রে আমরা উদ্বিগ্ন এ কারণেই যে, একজন বিচারক হয়ে তিনি যখন তার মেয়ের অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে তিলকে তাল করে ফেলেন, আর একজন জেলা প্রশাসক হয়ে স্যার ডাকটি শোনার জন্য একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের ওপর চড়াও হয়ে ওঠেন, তাহলে সাধারণ মানুষের আমলাতন্ত্রের প্রতি আস্থা আর ভরসার জায়গাটি আর কি ই বা অবশিষ্ট থাকে?
আমাদের সময় এসেছে মাঠ পর্যায়ে নিয়োগের আগে আমাদের সরকারি কর্মচারীদের আরও প্রশিক্ষিত করা, যাতে তারা সত্যিকার অর্থে জনগণের সেবক হয়ে উঠতে পারবেন সেটা নিশ্চিত করা। আবারও বলছি মাঠ পর্যায়ে আমলাতন্ত্র সাধারণ জনগণের কাছে দিনকে দিন এক অধরা বিষয় হয়ে উঠছে। এই দূরত্ব কমাতে হবে, সরকারের সেবাকে জনগণের কাছে সহজে পৌঁছে দেয়ার স্বার্থে। শুনতে খারাপ লাগলেও বলতে হয় যে আমলাতন্ত্রকে তাদের খোলস থেকে বের হয়ে কামলাতন্ত্রে পরিণত হতে হবে।
(লেখার মতামত লেখকের নিজের)