1. mahadihasaninc@gmail.com : admin :
  2. hossenmuktar26@gmail.com : Muktar hammed : Muktar hammed
সাংবাদিকদের শিক্ষক ছিলেন তিনি - dailybanglakhabor24.com
  • November 5, 2024, 12:02 am

সাংবাদিকদের শিক্ষক ছিলেন তিনি

  • Update Time : শনিবার, এপ্রিল ১, ২০২৩ | সকাল ৬:০২
  • 80 Time View

 

মনজুরুল আহসান বুলবুল

 

আজ ১ এপ্রিল, প্রয়াত সাংবাদিক গোলাম সারওয়ারের জন্মদিন। সারওয়ার ভাইয়ের জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করছি। তাঁকে ৮০তম জন্মবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। তিনি আমাদের মাঝে নেই। তবে জন্মদিনের এই দিনটি তাঁর মতো করেই তাঁকে নিয়ে কিছু বলতে চাই। সারওয়ার ভাইয়ের জন্মদিন যেহেতু ১ এপ্রিল, তাই প্রায় প্রতি বছরই এই দিবসটি ঘিরে তাঁর কাছের লোকজন বা অল্প পরিচিতরা প্রথমে চমকে যেতেন। দেখা গেল, তিনি কাউকে খাওয়ার জন্য দাওয়াত দিচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা মনে করতেন, এটা নিশ্চয় ১ এপ্রিল বিষয়ক কোনো ঘটনা। অর্থাৎ এপ্রিল ফুল পালনের কোনো আয়োজন হতে যাচ্ছে কিনা। সারওয়ার ভাইকে তাঁর জন্মদিন নিয়ে কখনও হইচই করতে দেখিনি। নিজে উদ্যোগ নিয়ে জন্মদিন উদযাপন করেছেন, এটাও আমার মনে পড়ছে না। তাঁর সাংবাদিক সহকর্মী থেকে শুরু করে কাছের লোকজন সবাই শুভেচ্ছা জানাতেন। সন্ধ্যার পর তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে হয়তো ঘরোয়া কোনো আয়োজনে অংশ নিতেন।

সারওয়ার ভাই ছিলেন ব্যবহারিক সাংবাদিকতার শিক্ষক। আমরা আরেক প্রয়াত সাংবাদিক এ বি এম মূসাকে ‘ব্যবহারিক সাংবাদিকতার শিক্ষক’ হিসেবে অভিহিত করে থাকি। আমার মনে হয়, সারওয়ার ভাইও তা-ই ছিলেন। সারওয়ার ভাই সম্ভবত বিরল সৌভাগ্যবানদের একজন যিনি কিনা আমাদের দেশে দুটি প্রথম সারির বাংলা পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর সারওয়ার ভাই সমকালের পাশাপাশি যুগান্তরেরও প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।

সংবাদপত্রের প্রাণ বলা হয় বার্তা কক্ষকে। ইত্তেফাকের প্রায় ৩ দশকের বার্তা সম্পাদকের জীবনে সারওয়ার ভাই কিংবদন্তির পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন নিজেকে। তিনি যে সময়ে ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক, সেই সময়ে আমি সংবাদের বার্তা সম্পাদক ছিলাম। সেই সময়ে সারওয়ার ভাই ছিলেন সম্ভবত সবচেয়ে সিনিয়র বার্তা সম্পাদক। অপরদিকে আমি ছিলাম তরুণতম বার্তা সম্পাদক। সেই সময়ে সারওয়ার ভাইয়ের নানা পরামর্শ পেয়েছি। একসঙ্গে কাজ করার অনেক আগে থেকেই সারওয়ার ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক। সংবাদে কাজ করতাম বলে তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। সংবাদের অনেকেই আমাকে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। তবে এ ক্ষেত্রে আমার এক ধরনের নির্ভরতা তৈরি হয় ইত্তেফাকের তৎকালীন বার্তা সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের ওপর। ইত্তেফাক কীভাবে হেডলাইন করে, কোন ছবি বড় করে ছাপে, প্রথম পাতার নকশা কেমন করে– এসব বুঝতে প্রতিদিন পত্রিকাটি দেখতাম। সারওয়ার ভাই বিষয়টি বুঝতে পারতেন।

ইত্তেফাকের সবাই জানেন, পরবর্তীকালে পারস্পরিক নির্ভরশীলতাও কীভাবে বেড়ে গিয়েছিল। প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় আমি ফোন করতাম অথবা সারওয়ার ভাই ফোন করতেন। নিউজ, ছবি ও মেকআপ সম্বন্ধে আমরা মতবিনিময় করতাম। দুটি সংবাদ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবে; এটা স্বাভাবিক। কিন্তু একটি মৌলিক বিষয়ে আমাদের ঐক্য ছিল। সেটি ছিল সংবাদের সঙ্গে আপস করা যাবে না। সারওয়ার ভাই একটানা পাঁচ দশকের বেশি সময় এ পেশায় মেধা, যুক্তিবোধ, পেশাদারিত্ব, দায়িত্বশীলতা, অসাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনার নিরবচ্ছিন্ন চর্চায় নিজেকে বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে এক অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর রাজনৈতিক চেতনা ছিল। নিজের রাজনৈতিক চেতনা আর সাংবাদিকতাকে কখনও মিশিয়ে ফেলেননি তিনি। ব্যবহারিক সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তিনি আদর্শ। সাংবাদিকতার অভ্যন্তরীণ সংকট এখন ভয়াবহ। এ সময় সারওয়ার ভাইকে বেশি মনে পড়বে– এটাই স্বাভাবিক। তিনি যথার্থ অর্থে সম্পাদকের পাশাপাশি সাংবাদিকতার শিক্ষক হয়ে উঠেছিলেন।

সারওয়ার ভাই সমকালের সম্পাদক হিসেবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে গিয়েছিলেন। প্রিয় সারওয়ার ভাই ছিলেন আমার সম্পাদক, আন্দোলন-সংগ্রামের সহযোদ্ধা, সাংবাদিকতার শিক্ষক ও অভিভাবক। তাঁর সঙ্গে আমার অসাধারণ ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। জীবদ্দশায় তাঁর জন্মদিনে অফিসে গিয়ে ফুলেল শুভেচ্ছা জানাতাম। পারিবারিকভাবে বড় পরিসরে তাঁর জন্মদিন উদযাপন না হলেও অফিসে স্বল্প পরিসরে তাঁর জন্মদিন উদযাপন করতাম। সারওয়ার ভাই শুধু আমাকে স্নেহই করতেন না; আমার সাংবাদিকসুলভ মেধারও মূল্য দিতেন। তিনি একবার এক মাসের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। যাওয়ার আগে ইত্তেফাকের বার্তা বিভাগের সহকর্মীদের বলেন, আমার সঙ্গে যেন প্রতিদিন যোগাযোগ রাখে। তাঁর কথামতো ইত্তেফাকের বার্তা বিভাগের বাতেন ভাই আমাকে ফোন করতেন। এভাবে আমাদের মধ্যে পেশাদারিত্বের দিক থেকে নির্ভরশীলতা তৈরি হয়েছিল বয়সের ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও। অনেকটা শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কের মতো। ছাত্র শিক্ষককে সম্মান করবেই; কিন্তু শিক্ষক যখন ছাত্রকে মর্যাদা দেন, তখন সেই ছাত্র উজ্জীবিত হয়।

আমাদের পেশাদারিত্বের নির্ভরশীলতার সম্পর্কটি একসময় ব্যক্তিগত নির্ভরশীলতার জায়গায় এসে দাঁড়ায়। আমি সাংবাদিক ইউনিয়ন করতাম। সাংবাদিকতা সম্পর্কিত কোনো জটিলতা সৃষ্টি হলে সারওয়ার ভাইয়ের সঙ্গে মতবিনিময় করতাম। তিনি তাঁর মতো করে আমাকে পরামর্শ দিতেন। আমি তাঁর পরামর্শ অবশ্যপালনীয় মনে করতাম। কৌশল নির্ধারণের ক্ষেত্রে সারওয়ার ভাইয়ের বড় ভূমিকা থাকত, তবে অনেকেই সেটি বুঝতে পারতেন না। তিনি যখন প্রেস ক্লাবকেন্দ্রিক বিভিন্ন আলোচনায় নেতৃত্ব দিতেন; সারাদিন আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে অনেক কথা বলতাম। কিন্তু রাতে অবধারিতভাবে হয় আমি তাঁকে ফোন করতাম অথবা তিনি আমাকে ফোন করতেন। আমি এখনও সম্মানিত বোধ করি– সারওয়ার ভাই যে কোনো ইস্যুতে অনেক মানুষের মতামত নিতেন। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আমার মতামত জানতে চাইতেন। সারওয়ার ভাই এ বিষয়টি গুরুত্ব দিতেন; টিম ওয়ার্কে বিশ্বাস করতেন। আমরা জানতাম– তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। কিন্তু তিনি আমাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতেন। সবাইকে গুরুত্ব ও মর্যাদা দেওয়ার প্রবণতা থেকে তিনি একজন সফল বার্তা সম্পাদক ও সফল সম্পাদকে পরিণত হয়েছিলেন।
সারওয়ার ভাই এক সময় ছড়া লিখতেন। সিনে-সাংবাদিকতায় হাত পাকিয়েছিলেন। সারওয়ার ভাইয়ের মধ্যে যেটা দেখেছি, তিনি সমাজের সব ক্ষেত্রের, পেশার মানুষের সঙ্গে একটি যোগাযোগ রাখতে পারতেন। একজন সাংবাদিকের যেটি বড় বৈশিষ্ট্য, সবার সঙ্গে যোগাযোগের রাস্তা খোলা রাখা– এটা সারওয়ার ভাই ভালোভাবে করতে পারতেন। এর ফলে কোনো রিপোর্টার কোনো নিউজ তৈরি করে জমা দিলে সেটিতে বাড়তি তথ্য যোগ করতে পারতেন। আবার তিনি চাইতেন যাতে একজন সাংবাদিকের সবকিছু পর্যবেক্ষণ করার ভালো ক্ষমতা থাকে। আগে পর্যবেক্ষণের মতো বিচক্ষণতা থাকতে হবে, তার পর লেখার দক্ষতা। আমাদের একজন আদালতবিষয়ক বিট করতেন। তিনি আদালত থেকে ফিরলে সারওয়ার ভাই সবকিছু শুনতে চাইতেন। তিনি সবকিছু ভালোভাবে তুলে ধরতে পারতেন। কিন্তু লিখে আনার পরে দেখা যেত, যা বলেছেন; তা কাগজেকলমে ঠিকঠাক আনতে পারছেন না। এই বিষয়ে সারওয়ার ভাই তখন রাগ করতেন। বারবার স্লিপ লিখে বদলে দিতেন। এভাবে বারবার কাটাকাটি করে চূড়ান্ত রূপ দিতেন। সারওয়ার ভাই আমাদের বলতেন খেলাধুলার নিউজ বিস্তারিত লিখতে। আবার সংবাদের শিরোনাম করতে বলতেন কোনো একটা গানের লাইন থেকে। বলতেন বেশি করে গান শুনতে, বই পড়তে। এভাবে শব্দভাণ্ডার বাড়ানোর পরামর্শ দিতেন। সারওয়ার ভাই একেবারে হাতেকলমে সাংবাদিকতা শিখিয়েছেন। কীভাবে বিরুদ্ধ সময়েও সঠিক সংবাদটি প্রকাশ করা যায়, তার শিক্ষা পাওয়া যেত তাঁর কাছে। সারওয়ার ভাইয়ের জন্মদিনে তাঁর সাংবাদিকতা চর্চার দিকে ফিরে তাকালে আমাদের এখনকার সংবাদমাধ্যম সঠিক পথের দিশা পাবে– এই প্রত্যাশা আমার। সারওয়ার ভাইকে আবারও শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করছি।

মনজুরুল আহসান বুলবুল : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category