মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যাবতীয় পানাহার ও স্ত্রী-সংশ্রব থেকে বিরত থাকার নাম সিয়াম। এ সময় ক্ষুধা-পিপাসার অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে রোজাদার আল্লাহর ভয়ে পানাহার থেকে বিরত থাকেন। প্রাণপ্রিয় স্ত্রী থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় শুধু আল্লাহর ভয়ে। সন্ধ্যায় ইফতারের পর ক্লান্ত-অবসন্ন শরীর যখন বিছানায় মিশে যেতে চায় তখনই তাগাদা আসে তারাবি নামাজের।
যুবক, বৃদ্ধ, কিশোর মিলে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তারাবি নামাজ আদায় করে। তারাবির পর বিশ্রামের জন্য যেতে না যেতেই আবার শেষ রাতে সাহরি খাওয়ার ডাক পড়ে। মনে চাইলেও এসব নিয়মের ব্যত্যয় করার কথা কল্পনাও করতে পারেন না বিশ্বাসী বান্দারা। এভাবে কাম, ক্রোধ, লোভ ও নানা রকম দোষণীয় স্বভাব যেগুলো মানুষকে নিয়ে যায় পশুর স্তরে, যেগুলো জš§ দেয় সমাজে নানা অশান্তি ও অনাচার- এসবের সঙ্গে রোজাদারের সংগ্রাম চলে এক মাসব্যাপী।
এক মাসের এ কৃচ্ছ্রসাধনা ও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মাধ্যমে মানুষ নিজের নফস বা প্রবৃত্তিকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। দেহ পরিচালিত হয় নৈতিক চরিত্র ও বিবেকের নির্দেশ মতো। এভাবেই মানব দেহের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় বিবেকের শাসন ও আল্লাহর রাজত্ব। ফলে মাটির মানুষ পরিণত হয় সোনার মানুষে।
রমজানের সিয়াম সাধনা থেকে পূর্ণমাত্রায় লাভবান হতে হলে প্রয়োজন খাঁটি আমানি জজবা। প্রয়োজন মহামহিম রব্বুল আলামিনের প্রতি আনুগত্য ও আত্মনিবেদনের অঙ্গীকার করা। নিজের চিন্তা, মনোভাব ও আচরণকে সাজাতে হবে মহান স্রষ্টার নির্দেশ অনুযায়ী। আর সে জন্য সহজ উপায় হলো রসুলে পাক (সা.) প্রদর্শিত রূপরেখা অনুসরণ। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও সমীহবোধ থাকার পাশাপাশি তাঁর আদর্শ ও পথ অনুসরণের দৃঢ় প্রতিজ্ঞাও ইমানের অপরিহার্য শর্ত।
আল্লাহর রসুলকে যেমন জগৎবাসীর জন্য কল্যাণ ও মুক্তির দিশারি হিসেবে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে হয়, তেমনি আল্লাহর নির্দেশাবলি ও ব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যের প্রতিও আস্থা রাখতে হয়। পরকাল ও অদৃশ্য জগৎ সম্পর্কে তিনি যা কিছু বলে গেছেন, সেগুলোর সত্যতা সম্পর্কেও কোনো সন্দেহ পোষণ করা যায় না।
ইমানের আভিধানিক অর্থ যদিও বিশ্বাস, কিন্তু ইমানের প্রকৃত মর্ম অনেক ব্যাপক ও গভীর। বিশ্ব জগতের স্রষ্টা ও নিয়ন্তা হিসেবে এক সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করাই এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। তেমনি এতটুকু জানা যথেষ্ট নয় যে, আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে আরব মরুর এক জীর্ণ কুটিরে জš§ নিয়ে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ নামের এক মহাপুরুষ জগৎবাসীকে শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের পথে আহ্বান জানিয়েছিলেন। কেননা হিজরতের পর মদিনায় শেষ নবীর প্রতি সবচেয়ে বিদ্বেষ পোষণ করত ইহুদি ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়। অথচ তারাও শেষ নবীকে নিশ্চিতভাবে চিনতে পেরেছিল। তাওরাত ও ইঞ্জিলে শেষ নবীর যে বিস্তারিত পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে, তা তাদের নখদর্পণে ছিল। প্রথম দর্শনেই তারা বুঝতে পেরেছিল ইনিই সেই নবী, যার সুসংবাদ দিয়ে গেছেন আগের সব নবী ও রসুল। এ প্রসঙ্গে কোরআন মাজিদেও বলা হয়েছে, ‘তারা তাঁকে (শেষ নবীকে) চেনে যেমন চেনে নিজেদের সন্তানকে। ’ এভাবে চিনতে পারার পরেও তারা মুমিন হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। কারণ ইমানের গভীর মর্মের মধ্যে নিহিত রয়েছে আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের অঙ্গীকার। তারা জেনে বুঝেও আল্লাহর বিধান ও রসুলের আদর্শের কাছে নিজের সত্তাকে সমর্পণে প্রস্তুত ছিল না।
ইমানের গভীরতা ও দৃঢ়তা যার যত বেশি, যে কোনো নেক কাজে তার সওয়াবের পরিমাণও বেশি হবে। আম্বিয়ায়ে কেরাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িন, তাবে তাবেয়িন, আধ্যাত্মিক বুজুর্গানে দীনের সঙ্গে সাধারণ মুমিনদের পার্থক্য এখানেই। আর এ কারণেই সবার মর্যাদা সমান নয়। তাই ইসলামের অন্যতম বুনিয়াদ মাহে রমজানের সিয়াম পালনের সার্থকতা ও সুফল প্রাপ্তির জন্য ইমানের পরিপক্বতা ও দৃঢ়তা প্রয়োজন। এ জন্যই আল্লাহ রব্বুল আলামিন রোজা পালনের নির্দেশ দানের সময় প্রথমেই বলেছেন, ‘হে মুমিনরা, তোমাদের ওপর সিয়াম পালনকে আবশ্যিক করা হয়েছে, যেমন তা আবশ্যিক করা হয়েছিল তোমাদের আগে যারা ছিল তাদের ওপর, যেন তোমরা মুত্তাকি হতে পার। ’ (সুরা বাকারা আায়াত ১৮৩)। অর্থাৎ রোজা তথা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত না খেয়ে থাকলেই কেউ তাকওয়াবান তথা মুত্তাকি হয়ে যাবে না। মুত্তাকি হওয়ার জন্য আগে তাকে মজবুত ইমানওয়ালা হতে হবে। তাই আসুন! আমরা রোজার ফরজিয়াত পালনের পাশাপাশি রোজার রুহানিয়াত হাসিলের জন্য বেশি বেশি ইমানের মেহনত করি। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দিন। আমিন।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর ।