1. mahadihasaninc@gmail.com : admin :
  2. hossenmuktar26@gmail.com : Muktar hammed : Muktar hammed
মুহিউদ্দীন খান: সাংবাদিকতায় আলেমদের কৃতিত্বের একাংশ - dailybanglakhabor24.com
  • November 7, 2024, 9:49 am

মুহিউদ্দীন খান: সাংবাদিকতায় আলেমদের কৃতিত্বের একাংশ

  • Update Time : সোমবার, এপ্রিল ১৭, ২০২৩ | বিকাল ৩:৪৯
  • 80 Time View

মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার

আলেম-ওলামাদের সচরাচর আমরা সেকালে এবং অনগ্রসর ভাবতে অভ্যস্ত। কিন্তু, প্রগতির চিন্তা-চর্চার পরতে পরতে তাদের পথচলার ইতিহাস অত্যন্ত গৌরবের। মুশকিলটা হচ্ছে, আলেম-ওলামাদের মধ্যে তা জানান দেয়ার গরজ আগেও ছিল না। এখনো নেই। আবার ইতিহাস রচয়িতাদের মধ্যেও এ বিষয়টি তুলে আনার প্রবণতা কম।
পাক ভারত উপমহাদেশে আলেমরা কেবল ধর্ম প্রচার করেছেন, ইমাম-মুয়াজ্জিনের ভূমিকায় ছিলেন-এমন একটি ধারনা দেয়া হয়। যা প্রকারান্তরে তথ্য গোপন করা, প্রকৃত ইতিহাস আড়াল রাখা। আলেম-ওলামাদের হাত দিয়ে এ অঞ্চলের রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি-কালচারের বিস্তর প্রসার হয়েছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে সংস্কারও এসেছে তাদের নেতৃত্বে। এমন কি সাংবাদিকতার বিকাশেও আলেমদের ভূমিকা ও অবদান অনেকের অজানা। মুসলিম বাংলার সাংবাদিকতার জনক ছিলেন একজন মাওলানা। নাম আকরাম খাঁ। শত বছরের কর্মময় জীবনে রাজনীতিরি চেয়ে তিনি বেশি করেছেন সাংবাদিকতা।
বাংলার মুসলমানদের সামাজিক জীবনের সংস্কার আনতে তিনি ১৯১০ সালে প্রকাশ করেছিলেন সাপ্তাহিক ‘মোহাম্মদী’ । পরের বছরই ত্রিপলি ও বলকান যুদ্ধের সময় তুরস্কের জাতীয়তাবাদের পক্ষে ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার ভূমিকার সঙ্গে আলেম সমাজের আলোড়ন অন্য রকম সাড়া তৈরি করে। এরপর মাওলানা মনিরুজ্জামান ইছলামাবাদীর সম্পাদনায় ১৯১৫ সাল থেকে প্রকাশ হয় ‘আল–ইসলাম’। পত্রিকাটি বাংলার মুসলিম সমাজে জাগরণ তৈরি করে। আরবী, ফার্সী ও উর্দুতে অসাধারণ পন্ডিত ছিলেন। সীতাকুন্ড মাদরাসায় থাকাকালে তিনি একদিকে মিসরের ‘আল-মানার’, ‘আল-আহরাম’ প্রভৃতি বহু বিখ্যাত পত্রিকায় আরবী প্রবন্ধ লিখতেন, অন্যদিকে উত্তর ও মধ্য ভারতের হিন্দি ও উর্দু পত্রিকায়ও লিখতেন।
মাওলানা ইসলামাবাদী সাংবাদিকতার জন্য শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় চলে যান। সেখানে তিনি ১৯০৩ সালে সাপ্তাহিক ‘ছোলতান’ ও দৈকি সুলতান পত্রিকা পুনঃপ্রকাশ করেন। এদিকে মাহাম্মদীর পর মাওলানা আকরাম খাঁ উর্দু ভাষায় ‘দৈনিক যামানা’ ও বাংলা ভাষায় ‘দৈনিক সেবক প্রকাশ করেন। সেবক পত্রিকায় ব্রিটিশ বিরোধী লেখার অপরাধে আকরাম খাঁকে এক বছর কারাভোগও করতে হয়। ১৯৩৬ সালের ৩১ অক্টোবর ‘দৈনিক আজাদ’ প্রকাশ করে বাংলা–আসামের অনুন্নত মুসলিম সমাজের চোখ ফুটাতে শুরু করেন তিনি।
১৯৬২ সালে আইয়ুব সরকারের ‘প্রেস এন্ড পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্স’ এর তীব্র সমালোচনা করে পত্রিকাটি। বার্ধক্য এবং অসুস্থতা নিয়েই ১৯৬৩ সালে তিনি এই অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধে ঢাকায় সাংবাদিকদের মিছিলে নেতৃত্ব দেন। আজকের প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকদের জন্য বিষয়টি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
ওই অভিযাত্রার সারথীদেরই একজন মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। ছাত্রজীবনেই সাংবাদিকতা ও সহিত্যচর্চায় ঝোক ছিল তার। টগবগে যুবক বয়সে হাতে তুলে নিয়েছিলেন শুধুই কলম। ছিলেন গ্রামের অভিজাত মধ্যবিত্ত দ্বীনদার পরিবারের সন্তান। শিশুবেলায় দেখেছেন অস্তমান ব্রিটিশ যুগের প্রতিনিধি জমিদার- জোতদারদের দাপট-উপেক্ষা। কোণঠাসা অবহেলিত পূর্ববঙ্গের মুসলিম মানসের পুরো প্রতিবাদী উত্তাপ তাঁর মগজজুড়ে ছড়িয়ে ছিল। গ্রামের পাঁচবাগ মাদরাসার পর ঢাকা আলিয়ায় এসে লেখাপড়া শেষ করেন। আলিয়া ধারায় দুটি শাখায় কামেল পাশ করেই কর্মের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। শিক্ষকতাসহ বিভিন্ন দিকে যাওয়ার সুযোগ তখন তাঁর সামনে ছিল। কিন্তু তিনি কলমের বন্ধন ছাড়েননি। মাসিক মদীনার মুহীউদ্দীন নামে পরিচিতি ছিল তার। কিন্তু, মাসিক মদীনা হলো তার পরবর্তী সৃষ্টি। এর আগে, তিনি ১৯৬০ সালে ‘মাসিক দিশারী’, ১৯৬৩ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ‘সাপ্তাহিক নয়া জামানা’ সম্পাদনা করেন। ১৯৬১ সাল থেকে আমৃত্যু ‘মাসিক মদীনা’ সম্পাদনা করেছেন।
এক সময় তার সম্পাদিত ‘আজ’ সাহিত্য মহলে সাড়া জাগায়। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ১৯৮৮ সালে সৌদিভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘রাবেতায়ে আলমে ইসলামী’র কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহলে তার বাড়তি পরিচিত যোগ হয়। দেশের বাইরেও বাংলাভাষীরা তার গুণমুগ্ধ পাঠক। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরাসহ প্রবাসে মরহুম খান নন্দিত লেখকের মর্যাদা পেয়েছেন। প্রতিভাধর মাওলানা মুহিউদ্দীন খান বাংলা ভাষায় ইসলামি সাহিত্য রচনা, সম্পাদনা ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলা ভাষায় সিরাত সাহিত্যের বিকাশে তার অবদান অবিস্মরণীয়। হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সা. সাহিত্যের আলাদা একটা বিষয় হতে পারেন; এবং সেটা হতে পারে অতুলনীয়, এ ধারণা বাস্তবও করেছিলেন তিনি।
বহুমাত্রিক কর্ম সাধনার এক জীবন্ত কিংবদন্তি আল্লামা মহিউদ্দিন খানের তথ্য ও সাহিত্যের বিন্যাসে মুগ্ধ হয়েছিলেন কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদও। এ নিয়ে ‘বিশ্বাসী হুমায়ূন ও ঐতিহ্য চিন্তা’ শিরোনামে একটি জাতীয় পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। যেখানে হুমায়ূন আহমেদের জীবনের একটি চমৎকার বিশ্বাসী দিক ফুটে উঠেছিল, তার আলোচনার অনেকটা অংশ জুড়ে ছিলো মাসিক মদীনার সম্পাদক মুহিউদ্দীন খান। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি তাঁর মতের একেবারে উল্টো দিকের লোকটিকেও কাছে টেনে নিতে পারতেন। এটা ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। হুমায়ূন আহমেদের বর্ণনায় যেভাবে ফুটে উঠেছে সেই কথা …‘এই শহরে একজন আলেম আছেন। দারুণ লিখতে পারেন। বেশ শক্ত তাঁর কলম। সমীহ করি। তিনি খান সাহেব। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। মাসিক মদীনার সম্পাদক। তিনি আমার পিতার প্রতিচ্ছবি।….আমার বাবা একাত্তরের শহীদ ফয়জুর রহমান ছিলেন মদীনা পত্রিকার পাঠক। মা’ও মদীনা পড়তেন। প্রতি মাসে ডাক পিয়ন বাসায় মদীনা দিয়ে যেত। কদিন আগে হুজুরকে দেখতে তাঁর অফিসে গিয়েছিলাম মোহনলালের মিষ্টি নিয়ে। পা ছুঁয়ে কদমবুছি করতেই তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। আমি কেঁদে দিয়েছিলাম। যেন বাবার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ….. বইমেলায় সবাই আমার বই নিয়ে ব্যস্ত থাকে আর আমি খুঁজি মুহিউদ্দীন খানের লেখা নতুন বই। এই যে তাঁর লেখা ‘কুড়ানো মানিক’ এটা আমার পড়া সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ।’
১৯শে রমজান ১৪৪৪হিজরি, ১১ এপ্রিল ২০২৩, মঙ্গলবার দিনটি ছিল মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী । ২০১৬ সালের ২৫ জুন মাহে রমজানের ইফতারের পরপরই তিনি মহান আল্লাহ তায়ালার ডাকে সাড়া দিয়ে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেন। সময়ের সল্পতার কারণে আমি এই ১৯ রমজান তাহার জন্য কোনো অনুষ্ঠান করতে পারিনি। রমজানের পরপরই তাহার কর্মময় জীবনের উপর একটি বিশেষ সেমিনারের আয়োজন করার জন্য প্রস্তুতি চলছে, আমার জাতীয় জনতা ফোরাম কেন্দ্রীয় সংসদের পক্ষ থেকে । মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে এভাবে এই ছোট পরিসরে লেখায় শেষ করা সম্ভব নয়। সামনে সেমিনার আলোচনায় বিস্তারিত তুলে ধরা চেষ্টা করবো।

মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের জন্ম ১৯৩৪ সালের ১৯ এপ্রিল মোতাবেক বাংলা ১৩৪১ সালের ৭ বৈশাখ, গফরগাঁও জেলার শাখচূড়া গ্রামে। তার শিক্ষা জীবন, গফরগাঁও আলিয়া মাদ্রাসায় প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে আলিম পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ফাজিল, কামিল (টাইটেল) বিভাগে হাদিস ও ফিকাহ শাস্ত্রদ্বয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। সম্ভবত এটি ১৯৫৬ সালের কথা।
মাওলানা মুহিউদ্দীন খান বংশগত দিক থেকেও ছিলেন এক সম্ভ্রান্ত বংশের কৃতী সন্তান। তার পিতার নাম হাকীম মাওলানা আনসার উদ্দীন খান। এ উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি দুবার কারাবরণ করেন। তিনি একজন আলেমে দ্বীন হওয়ার পাশাপাশি একজন রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক এবং সমাজসেবক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার সুযোগ্য পুত্র মাওলানা মুহিউদ্দীন খান তার বংশ ঐতিহ্যের ধারক-বাহক হওয়া ছাড়াও পিতার মিশনকে আরো বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যান সফলভাবে।

আলেমদের তথা মাওলানা মুহিউদ্দীনের সম্পর্কে হুমায়ূন আহমেদের এমন অনুভূতির মাঝে আজকের প্রেক্ষাপটে লেখক- সাংবাদিকদের জন্য অনেক ভাবনার খোরাক আছে। যদি কারো সেই উপলব্ধি থাকে। মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে ‘মদীনা’ নামের একটি মাসিক ইসলামী সাময়িকী প্রকাশ করা মোটেই সহজ ব্যাপার ছিল না। তখন ১৯৬১ সাল। তখনকার সময়ে কাজটি সহজ ছিল না। তাঁর নিজেরও সঙ্গতির সমস্যা ছিল। কিন্তু তিনি দমে যাননি। তাঁর এ সাময়িকীই ইতিহাস ও কিংবদন্তিতে পরিণত হয়। ‘মদীনা’ একটি যুগের জন্ম দেয়। ভাবা যায় এ স্বপ্নযাত্রা কতো কঠোর ছিল? তাও সেই হ্যান্ড কম্পোজ যুগে। যা আজকের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের জন্য অনেক শিক্ষা-অনুপ্রেরণার বিষয়। গবেষণারও বিষয়।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বাংলা পোস্ট -| প্রকাশক বাংলাদেশ জ্ঞান সৃজনশীল প্রকাশনা

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category