অধ্যাপক ডক্টর আবু সাইয়িদ
১৭ এপ্রিল। ১৯৭১। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথ দিবস। প্রায় সারা রাত ধরে একটি বাসে যাত্রা করে সকালে এসে থামলাম ভারতের বিএসএফ ক্যাম্পের কাছাকাছি।
তারা আমাদের রুটি, ডাল ও এক মগ চা খাওয়াল। একটু দূরে বাংলাদেশ বর্ডার। ভারতের সীমান্ত থেকে প্রায় ১ হাজার গজ দূরে বৈদ্যনাথতলা। সেখানেই সরকারের শপথ অনুষ্ঠান।
এই শপথ অনুষ্ঠানের নেপথ্যে অন্য একটা দিকও আছে। ৩ ও ৪ এপ্রিলে তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম (ছদ্মনাম রহমত আলী) দিল্লি গিয়ে পি এন হাকসারের সঙ্গে কথাবার্তা বলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। তাজউদ্দীন আহমদকে আলোচনার এক পর্যায়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জানতে চান, ‘আপনাদের সরকার গঠিত হয়েছে কি না?’ তাজউদ্দীন আহমদ তাৎক্ষণিকভাবে জবাব দিলেন, বঙ্গবন্ধু যে হাইকমান্ড গঠন করেছিলেন তাদের নিয়েই সরকার গঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও খন্দকার মোশতাক আহমদ।
জেনারেল ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনার সময় উপরোক্ত এই পাঁচজনকে নিয়েই তিনি আলোচনা করতেন। কৌশল নির্ধারণ করতেন। বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তির বিষয়ে কথাবার্তা বলতেন। মূলত সরকার গঠনের জন্য বঙ্গবন্ধু পূর্ব থেকে এই হাইকমান্ড গঠন করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর গ্রেফতার হয়ে যান।
সরকার গঠনের দায়িত্ব অর্পিত হয় এই নেতৃবৃন্দের ওপর। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনার এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলার ছাত্র, যুবক এবং সর্বস্তরের মানুষ স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে উদ্দীপ্ত হলো। ২৩ মার্চ পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে দিয়ে সারা বাংলায় সর্বত্র স্বাধীন বাংলার মানচিত্র সংবলিত পতাকা শোভিত হলো। তার পূর্বে লক্ষ জনতার সামনে ৩ মার্চ ইশতেহার পাঠ করা হলো। বলা হলো, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জাতীয় সংগীত গীত হলো। ইয়াহিয়া খান দেখলেন, পাকিস্তানের পরিবর্তে বাংলাদেশের পতাকা হয়েছে। গীত হয়েছে জাতীয় সংগীত। তারপরও নিয়মতান্ত্রিক আলোচনার জন্য শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে কীভাবে এই রাষ্ট্র-সংকট থেকে উত্তীর্ণ হওয়া যায় বঙ্গবন্ধু সেই কৌশল গ্রহণ করেন। ইয়াহিয়া খানের পক্ষ থেকে বিচারপতি কর্নওয়ালিস ও কর্নেল হাসানের সঙ্গে ২৪ তারিখ তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন দেখা করেন। সাংবাদিকদের তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, সর্বশেষ কথা বলে এসেছি। বর্তমান অবস্থায় অপরিহার্য হলো ‘কনফেডারেশন’। জেনারেল ইয়াহিয়া খান দেখলেন, মুজিব কৌশলে এমন একটি ঘোষণা চান যা পাকিস্তানকে খন্ড-বিখন্ড করবে। এ অবস্থায় ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য সশস্ত্র আক্রমণ শুরু হলো। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। প্রতিরোধ যুদ্ধ সর্বত্র। বিভিন্ন জেলায়, পাড়ায়, মহল্লায় এই যুদ্ধকে সুসংহত ও সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজন ছিল নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচিত সরকার।
তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম প্রমুখ সেই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। দিল্লি থেকে যখন তারা কলকাতায় এলেন তখন যুবনেতারা তাজউদ্দীন আহমদকে চেপে ধরলেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিতর নয়, স্বাধীনতার জন্য বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করতে হবে। প্রচন্ড বাধা। হইচই। বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। সমগ্র বিষয়টি ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বিশ্লেষণ করার পর উপস্থিত গণপরিষদ সদস্যদের অধিকাংশই তা সমর্থন করেন। শুরু হলো বাংলাদেশ সরকারের নবযাত্রা।
১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গৃহীত হলো এবং সেখানে গণরায় বানচাল ও বাংলার জনগণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের বিশ্বাসঘাতকতা, অকস্মাৎ ও নৃশংস আক্রমণে লক্ষ লক্ষ শহীদ ও প্রায় ১ কোটি শরণার্থী ভারতের দিকে ধাবিত হয়। এই পরিস্থিতিতে সরকার গঠন ছিল অতীব জরুরি। আজ ইতিহাসবিজ্ঞানীদের নির্দ্বিধায় বলা উচিত, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রের জন্মসূত্র এবং ভিত্তি। এই ঘোষণাপত্রে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিতকরণে আমরা যে শপথ নিয়েছিলাম আজ তা কি বাস্তবায়িত হয়েছে? এর আলোকে সংবিধানে আমরা লেখেছিলাম, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। যার ভিত্তি হলো ১০ এপ্রিল। পৃথিবীতে কেবল দুটি দেশ লিখিতভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা জারি করে। সরকার গঠন করে। যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। একটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অন্যটি আমার প্রিয় বাংলাদেশ। মার্কিনি ঘোষণায় ৫৭ জন স্বাক্ষরিত। বিধাতাসৃষ্ট সব মানুষের প্রতি সমতা, জাস্টিস এবং মানুষের অধিকার ঘোষিত হয়। তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে আজও মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী। আমরাও তেমনি আদর্শ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। উল্লেখ্য, ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে পূর্ণ সহযোগিতা করেছিল ফ্রান্স তেমনি আমাদের স্বাধীনতায় সহযোগিতা করেছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। এ জন্য আমরা চিরকৃতজ্ঞ।
১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস ছিল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র মুজিবনগর দিবসের ওই দিনে চিফ হুইপ ইউসুফ আলী সাহেব পাঠ করেছিলেন। সত্য হলো, স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের মূল প্রণেতা ছিলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, তা দেখে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। আজকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পূর্ণ মর্যাদা সহকারে কেন ১০ এপ্রিল আমরা পালন করি না? তাদের মর্যাদা ও সম্মান কোথায়? অথবা যে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের অঙ্গীকার করেছিলাম আজকে বাংলাদেশে তার বাস্তবায়ন কেন হয়নি? এর দায়ভার আমাদের সবাইকে নিতে হবে। তারপরও মুজিবনগর দিবসের তাৎপর্য হলো এই যে, বিশ্ববাসী দেখল বাংলার মাটিতে বাংলাদেশের সরকার গঠিত হয়েছে, পতাকা উড্ডীন হয়েছে, জাতীয় সংগীত গীত হয়েছে, রাষ্ট্রীয়ভাবে সামরিক মর্যাদায় স্যালুট অভিবাদন দেওয়া হয়েছে। এ অনুষ্ঠান কূটনৈতিকভাবে সারা বিশ্বকে আলোড়িত করেছে, একই সঙ্গে বিশ্ব জনমত গঠন ও বাংলাদেশকে প্রতিনিয়ত দৃশ্যমান করে তুলেছে। এটা কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়।
লেখক : ’৭২ সালের খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী