1. mahadihasaninc@gmail.com : admin :
  2. hossenmuktar26@gmail.com : Muktar hammed : Muktar hammed
মুক্তমনের জয় হোক - dailybanglakhabor24.com
  • July 9, 2024, 4:09 pm

মুক্তমনের জয় হোক

  • Update Time : রবিবার, এপ্রিল ১৬, ২০২৩ | রাত ১০:০৯
  • 70 Time View

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

স্বাধীন যুক্তিবাদী চিন্তার একটা ধারা আমাদের জমিনে সবসময় ছিল। স্বাভাবিক ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের পাশাপাশি শিল্প সংস্কৃতির উদযাপনে আমাদের ছিল মুক্তমন। এ মুক্তমনে এক ভয়াবহ সংকট এসেছে আজ। সাধারণ মুসলিম মানুষ উদার, কিন্তু কতিপয় ধর্মব্যবসায়ী কট্টরবাদ ব্যবহার করে বিরোধের রাজনীতি করেন। এরা পহেলা বৈশাখের বিরোধিতা করে, এরা একুশে ফেব্রুয়ারির বিরোধিতা করে, এরা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে এবং এরা শিক্ষিত সাম্প্রদায়িক।

এ শ্রেণিরই প্রতিনিধি এক আইনজীবী পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকারকে আইনি নোটিশ দিয়েছেন। তার দৃষ্টিতে মঙ্গল শব্দটি একটি ধর্মীয় সংশ্লিষ্ট শব্দ। সব ধর্মের লোকজন তাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে মঙ্গল প্রার্থনা করে থাকেন। এখন এ মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের দৈত্য আকৃতির পাখি, মাছ ও বিভিন্ন প্রাণীর ভাস্কর্য প্রদর্শনের মাধ্যমে মুসলিম জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হচ্ছে, যা বাংলাদেশ সংবিধানের সরাসরি লঙ্ঘন বলে জানান এ আইনজীবী।

তাকে বোঝানো সম্ভব নয় যে, এই যে পাখি, মাছ ও বিভিন্ন প্রাণীর মুখোশ থাকে শোভাযাত্রায় তার কারণ প্রকৃতি। মানুষ প্রকৃতির অংশ এবং আমাদের বাস করতে হয় অন্যান্য প্রাণীকে সঙ্গে নিয়ে, তাদেরও বাঁচতে দিয়ে। এ আইনজীবী আইনি নোটিশ দিয়েছেন। কিন্তু আমরা একটা সহিংস সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর কথাও জানি যারা আমাদের চিরাচরিত সাংস্কৃতিক সব উৎসব বন্ধ করে দিতে চায়। এরাই রমনার বটমূলে বোমা হামলা করে অসংখ্য উদারমনা মানুষকে হত্যা করে, এরা উদীচীর সমাবেশে হামলা করে, এরা পথনাটক, যাত্রা বন্ধ করতে সক্রিয় থাকে।

আজ সবখানে যেন বিরোধের গান। ধর্মীয়ভাবে সবকিছুকে বিভাজিত করে দেখা। অথচ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর তৎপরতা ও তাদের অনুসারীদের সহিংসতা সত্ত্বেও এ জনপদে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঘাটতি ছিল না। তাহলে আজ কেন এরা এত সাহসী, কেন উদ্ধত—এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা প্রয়োজন।

ব্রিটিশ শাসন আমলে ইংরেজদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে বিষবাষ্পের সৃষ্টি করে। ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান তৈরি হওয়ার পর ধর্ম কার্ড ব্যবহার করে শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করার দর্শন তৈরি করে পাকিস্তানিরা। এরাই হিন্দু নিপীড়ক, এরা রবীন্দ্রসংগীতবিরোধী, এরা বাঙালিবিরোধী। এদেরই পরাজিত করেছিলাম ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে।

কিন্তু এত ত্যাগের বিনিময়ে যে দেশ সেখানে কেন এত ধর্মীয় উন্মাদনা? আজ পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ। অথচ আজ আমাদের লিখতে হচ্ছে শিক্ষিত মানুষের সাম্প্রদায়িক মন নিয়ে। নতুন বছরের দ্বারে দাঁড়িয়ে আমাদের সম্প্রীতির কথা বলতে হচ্ছে, যা কি না আমাদের বহুদিনের সংগ্রামের অর্জন। সম্প্রীতি হলো এমন ভ্রাতৃত্ববোধ, যা একাত্মতা সঞ্চার করে সমগ্র জাতির মধ্যে। মুসলমান, হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায় বাংলাদেশে ছিল তাদের সব জীবনধারা, জীবনচর্চা আর সংস্কৃতির ভিন্নতাকে ঐক্যবদ্ধ করে। তিপ্পান্ন বছর আগের মুক্তির লড়াইয়ের সময়কার এ ধারণাটি এখন যেন এক অলীক কল্পনা। কারণ বারবার আমাদের কোনো না কোনো ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আমাদের জন্য যে অন্ধকার সমাজ সৃষ্টি করেছিল তা থেকে মুক্ত হইনি আমরা।

এই তো সেদিনের কথা। এক কলেজ অধ্যাপিকাকে প্রকাশ্যে রাজপথে হেনস্তার শিকার হতে হয়েছিল কপালে টিপ পরার কারণে, তাও এক পুলিশ সদস্য দ্বারা। তিনি নাজমুল তারেক, ডিএমপির প্রোটেকশন বিভাগে কাজ করতেন। সাধারণ মানুষকে তিনি কী-রকম সুরক্ষা দেন সেটা বোঝা গেল ভালোভাবেই। লতা সমাদ্দার শিক্ষিত, সৎ, সাহসী ও সচেতন মানুষ। তাই তিনি প্রতিবাদ করেছেন। এ শিক্ষককে হেনস্তা করার প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রতিবাদ হয়েছিল, জাতীয় সংসদেও বিষয়টি উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত সেই কনস্টেবলকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। কিন্তু একটা সুগঠিত সেবা বাহিনীর ভেতর যে মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীলতার বাড়-বাড়ন্ত আছে তার প্রমাণ শুধু এই কনস্টেবল নন, আরও অনেকেই দিয়েছেন। ধন্যবাদ দিতে হয় পুলিশ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যারা এগুলোকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন না।

হলি আর্টিজান ক্যাফেতে ভয়ংকর জঙ্গি হামলার পর বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জঙ্গি খতমে বড় সাফল্য দেখিয়েছে। কিন্তু এরা যে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছে, তার প্রমাণ পাওয়া গেল যখন এদেরই কথায় পাঠ্যবই বদলাতে হয়, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে জাস্টিসিয়ার ভাস্কর্য সরাতে হয়।

পাঁচ দশকেরও বেশি সময় আগের পাওয়া স্বাধীনতার হাত ধরে মানুষের মধ্যে একটা বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল যে, এ দেশে আর সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দেখতে হবে না, ধর্মীয়ভাবে মানুষে মানুষে বিভাজন দেখতে হবে না। এ আশার আলো জ্বালিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীনতার আগে ও পরের রাজনৈতিক নেতাদের অবদান আছে। এখানে বলে নেওয়া ভালো যে তখনো রাষ্ট্রনেতারা যে সাম্প্রদায়িকতায় ক্ষেত্রে ধোঁয়া তুলসীপাতা ছিলেন, এমন নয়। তবে সরাসরি রাজনীতিতে থেকে উসকানি দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন।

কিন্তু ১৯৭৫-এ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে যে রাজনীতির সূচনা হয় তা ছিল ধর্মীয় উন্মাদনায় ভরপুর পাকিস্তানি রাজনীতির রেপ্লিকা। সেটি আরও পল্লবিত হয়ে সামরিক শাসক জিয়া ও এরশাদের মাধ্যমে।

পাঁচের দশক থেকে দেশের প্রগতিশীল বামদের পাশাপাশি একটা উদারনৈতিক রাজনীতির শক্তি সংগঠিতভাবে মানুষকে সচেতন ও প্রগতিমুখী করার কাজ করেছিল। এদের সামনের কাতারে ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং অবশ্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজ সেই শক্তিতে বেশ ঘাটতি দেখা যাচ্ছে এবং ঘাটতি আছে বলেই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ১৯৭২-এর সংবিধানে ফেরা হলেও সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের মতো এক বিভাজিত দর্শন বিধান রেখে দিতে হয়।

এ দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে বিভেদকামী রাজনীতি। বর্তমানে রাজনীতির ভেতর থেকে মেধাশক্তি কিংবা চিন্তাশক্তির ক্ষয় ঘটছে। মেধাবীরা আর রাজনীতি করছে না তার দুর্বৃত্তায়িত চরিত্রের কারণে। আর সে কারণেই মৌলবাদী শক্তি রাজনীতির হাতিয়ার এখন। জিয়া, এরশাদ, পরবর্তী সময়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে জামায়াত-বিএনপির যৌথ শাসন মৌলবাদী শক্তির হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। সমস্যার গভীরতা সেখানেই। মৌলবাদী জঙ্গি রাজনীতির প্রতি স্বাভাবিক রাজনীতির গাঁটছাড়া সম্পর্ক। বাংলাদেশের মতো দেশে, ছোট্ট ভূমিতে বিশাল জনসংখ্যা। সহজেই উন্মাদনা সৃষ্টি করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানো যায়। আসলে এক বিশাল ভয় বা আতঙ্ক ধীরে ধীরে গ্রাস করছে মনে। এই রবীন্দ্র-নজরুলের বাংলায় সম্প্রীতির যে পরিবেশ এবং তা বজায় রাখার যে স্পৃহা মানুষের মধ্যে ছিল, তা কেমন যেন এখন ঠুনকো হয়ে ভেঙে পড়ছে। শিক্ষিত সমাজের এক অংশ যখন যুক্তিকে হারিয়ে, বিক্রিত বিকৃত আবেগের দ্বারা পরিচালিত হয়, তখন বলতেই হয়, সাম্প্রদায়িক মানসিকতা আমাদের সমাজের অনেক গভীরে প্রবেশ করেছে। চতুর্দিকে যা চলছে, তা দেখে মানুষের জন্য মানুষ—এমন বহুল চর্চিত কথাও যেন আজ ফিকে হয়ে গেছে।

আমরা আধুনিক হচ্ছি, এগিয়ে যাচ্ছে বলে দাবি করছি। কিন্তু আসলে কি তাই? ক্রমেই পিছে হাঁটছি যেন এবং সেই নমুনাই মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে এই চিঠি। ধর্মের জিগির তুলে, কাউকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলতে গা কাঁপে না এ শ্রেণির। চারদিকে শুধু ভয়ের দেয়াল ঘিরে ফেলছে মানুষকে। শিক্ষিত বিবেকের এখন বড়ই অভাব। যুক্তি দিয়ে সমস্যা বোঝা এবং তার সমাধানের চেষ্টা তাই এখন বিশেষভাবে জরুরি। আবার একটা নবজাগরণের খুব দরকার আমাদের। প্রত্যাশা করছি আজ বড় শোভাযাত্রা হবে, আরও বেগবান হবে সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধের মিছিল। সম্প্রীতি যেন শুধু খাতা-কলমে আর বাণীর মধ্যে আবদ্ধ না থাকে। উদারতা আমাদের মনে, বিশ্বাসেও জেগে থাকুক সবসময়।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category