মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার
আজ ১৭ রমাদান, ঐতিহাসিক বদর দিবস।
ইতিহাসে যতগুলো যুদ্ধ মুসলমানদের সাথে বিভিন্ন সম্প্রদায় বা জাতিগোষ্ঠীর কিংবা বিধর্মীদের সাথে সংঘটিত হয়েছে, তার মধ্যে বদরের যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বদরের যুদ্ধের তাৎপর্য ঐতিহাসিক। এ যুদ্ধটি ছিল ইতিহাস নির্ধারণকারী একটি লড়াই। বদরের যুদ্ধে যদি মুসলমানেরা পরাজিত হতেন, তাহলে দ্বীন ইসলামে মহান আল্লাহকে ডাকার মতো কোনো লোক এই পৃথিবীতে থাকত কি না তা কেবল সেই মহান সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কারো জানা ছিল না। শত্রুদের দৃষ্টিতে বদরের যুদ্ধ ছিল, সবে চারা গজাচ্ছে- সেই ইসলাম ধর্ম নামক অঙ্কুরকে আল্লাহর জমিন থেকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার যুদ্ধ। বদরের যুদ্ধের অপর একটি তাৎপর্য হলো, দ্বীন ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সা:কে একজন সেনাপতির দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। বদরের যুদ্ধের তৃতীয় তাৎপর্য হলো, মহান আল্লাহ তায়ালা অনেকটাই অদৃশ্যমানভাবে তাঁর প্রিয় বান্দাদের বিপদে কিভাবে সাহায্য করেন, তার জ্বলন্ত প্রমাণ এই যুদ্ধে বিদ্যমান।
‘বদর’ নামক স্থানের পরিচিতি
বদরের যুদ্ধ হয়েছিল হিজরি দ্বিতীয় সালের ১৭ রমজান; আজ থেকে কয়েক দিন পর ১৭ রমজান আমাদের কাছে উপস্থিত হবে সেই বদরের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে। আশা ও প্রার্র্থনা করব মুসলিম সমাজের কাছে, ১৭ রমজান আপনারা বদরের যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করবেন, দোয়া করবেন এবং সেসব শহীদের রূহের মাগফিরাত কামনা করবেন, যারা এই যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন দ্বীন ইসলামকে আল্লাহর জমিনে টিকিয়ে রাখার জন্য। বদর একটি জায়গার নাম। মক্কা শরিফ থেকে কিছুটা উত্তরে, মদিনা শরিফ থেকে কিছুটা দক্ষিণ-পশ্চিমে। প্রায় চৌদ্দ শ’ একত্রিশ কিংবা বত্রিশ বছর আগে ওই আমলের আরব দেশে মক্কা নগরীর কুরাইশদের সাথে যে বাণিজ্য হতো, সেই বাণিজ্যের কাফেলাগুলো চলাচল করার যে পথ ছিল, সেটি ‘বদর’ নামক জায়গার পাশ দিয়েই যেত।
যুদ্ধের প্রেক্ষাপট : মক্কাবাসীর চিন্তা:-
মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে চলে এলেন। তারপর মদিনাতে নতুন একটি নগররাষ্ট্র, নতুন সভ্যতা, সংস্কৃতি, স্বকীয়তা এবং দ্বীন ইসলামের মূল কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছিলেন। এটা দেখে মক্কার কুরাইশরা ঈর্ষান্বিত হলো। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে তারা নানা ষড়যন্ত্রের পথ খুঁজতে লাগল। কুরাইশরা চিন্তা করল, আমরা তো সবাই মিলে মক্কায় তাঁকে (মুহাম্মদ সা:) দমন করে রাখতে পেরেছিলাম, কিন্তু এখন মদিনায় গিয়ে তিনি নতুনরূপে বাধাহীনভাবে ইসলাম প্রচার করে চলেছেন । যদি এরূপ অত্যাচার চলতে থাকে আর তার এই সংগ্রাম অগ্রসর হতে থাকে, তাহলে অচিরেই মদিনার মুসলিমগণ মক্কার লোকজনের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। অতএব, অঙ্কুরেই তাদের বিনাশ করা প্রয়োজন।
যুদ্ধের প্রেক্ষাপট : মদিনাবাসীর চিন্তা
অপর দিকে, সবেমাত্র জন্ম নেয়া মদিনা নামক নগররাষ্ট্র তথা ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি ক্রমবর্ধমান হলেও মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: এবং তার সাথীরা চিন্তা করলেন, আমরা মক্কা থেকে বের হয়ে এসেছি ঠিকই; কিন্তু মক্কার হুমকি থেকে আমরা এখনো মুক্ত হতে পারিনি। আমরা এখনো তেমন শক্তি অর্জন করতে পারিনি। তাই আগে আমাদের শক্তি সঞ্চয় করা প্রয়োজন এবং আল্লাহর দ্বীনকে তার জমিনে প্রতিষ্ঠা করতে হলে শত্রুদের মোকাবেলা করার কোনো বিকল্প নেই। মোটামুটি এ ধরনের চিন্তাভাবনার পরই মক্কা ও মদিনা- এ দুই শহরকেন্দ্রিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। তা ছাড়া পরোক্ষভাবে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নির্দেশ এসেছিল যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করার।
প্রস্তুতি পর্ব :-
অবশেষে রাসূল সা:-এর নেতৃত্বে মদিনা থেকে মুসলমানদের একটি দল বের হলো। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মক্কা নগরীর আরবদের বাণিজ্য কাফেলা, যেটা সিরিয়া থেকে ধনসম্পদ নিয়ে মক্কায় ফেরত যাবে তাদের মোকাবেলা এবং তাদের কাছ থেকে কিছু সংগ্রহ করা। সেজন্য তারা চলাচলের রাস্তার পাশে ওঁৎ পেতে ছিলেন। অপর দিকে ধনসম্পদ নিয়ে মক্কা নগরীর ব্যবসায়ীদের কাফেলা সিরিয়া থেকে ফেরত আসার সময় সংবাদ পেল যে, এই পথ ধরে গেলে পথিমধ্যে তাদের বিপদে পড়ার আশঙ্কা আছে। তাই তারা সবার সিদ্ধান্তক্রমে তাদের গতিপথ একটু পরিবর্তন করে মক্কায় যাওয়ার জন্য নতুন পথ আবিষ্কার করল এবং সেই পথ ব্যবহার করে তারা মক্কার কাছাকাছি চলে গেল। কিন্তু ইতোমধ্যে অন্য একটি ঘটনার উদ্ভব হলো। বাণিজ্য কাফেলার অনুরোধে মক্কা থেকে একদল সৈন্য অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রওনা দিয়েছিল কাফেলাকে এগিয়ে আনার জন্য। মক্কা থেকে উত্তর দিকে যে পথ ধরে বাণিজ্য কাফেলা আসছে সেই পথ ধরে, যাতে পথিমধ্যে বাণিজ্য কাফেলার ওপর কোনো বিপদ-আপদ এলে তারা সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারে। কিন্তু বাণিজ্য কাফেলা মদিনার মুসলমানদের দৃষ্টি এড়িয়ে চলে গেল। এমনকি মক্কা থেকে আসা সাহায্যকারী লোকদেরও দৃষ্টির অগোচরে চলে গেল। মক্কা থেকে আগত সাহায্যকারী দল যখন বদর নামক স্থানে এসে অবস্থান করছিল তখন তারা সংবাদ পেল মুসলমানেরা তাদের আশপাশে আছে। মুসলমানেরা বদর নামক স্থানটির কাছেই অবস্থান করছিল। ফলে তারাও জানতে পারল, মক্কা থেকে আগত এবং অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত একদল সৈন্যবাহিনী তাদের পাশেই অবস্থান করছে। যুদ্ধটি চূড়ান্তরূপে দেখা দিলো। বদর নামক স্থানে কাফেররা এক দিকে অবস্থান নিলো, অন্য দিকে মুসলমানেরা অবস্থান নিলো। মুসলমানবাহিনী যে স্থানটিতে অবস্থান নিলো, সেখানে একটি পানির কূপ ছিল; পানি আহরণের জন্য কুয়ায় সহজে যাওয়া যেত। যেহেতু পানির কূপটি মুসলমানদের দখলে, সেহেতু কাফেররা পানির সঙ্কট অনুভব করল। কূপের পাশেই একটি পাহাড়, সেখানে মুসলমানদের সদর দফতর স্থাপন করা হলো। একটি তাঁবুর বন্দোবস্ত করা হলো, সেখানে রাসূলে পাক সা: অবস্থান নিলেন। এলাকাটি ছিল সমতল, কিন্তু তিন দিকে পাহাড়বেষ্টিত।
আমাদের করণীয় :
সর্বাবস্থায় আল্লাহর সাহায্য কামনা করা : আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের বদরের এই বিজয়ের কথা স্মরণ করে দিয়েছেন যে, সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও বদর প্রান্তরে আল্লাহ তায়ালা তাদের বিজয় ও সফলতা দিয়েছেন। সুতরাং একইভাবে সেসব ক্ষেত্রে তিনি সাহায্য করতে সক্ষম, যখন আল্লাহর ওপর ভরসা করে সততা ও ইখলাছসহকারে তাঁর দ্বীনের পতাকা বুলন্দ করার লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে। বদরের যুদ্ধের সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় বিষয় ছিল- সব কিছুর জন্য সবার উপরে মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করা। এই যুদ্ধ প্রমাণ করে সংখ্যা ও যুদ্ধ সরঞ্জামের কমবেশি হওয়া বিজয়ের মাপকাঠি নয়। বরং মহান আল্লাহর ওপর দৃঢ় ঈমান ও নির্ভরতা হলো বিজয়ের মূল হাতিয়ার। এই যুদ্ধ মুসলমানদের শিখিয়েছে জাগতিক সব প্রস্তুতির পরেও সাফল্যের জন্য নির্ভর করতে হবে একমাত্র মহান আল্লাহর ওপর। তবেই মহান আল্লাহর সাহায্য আসবে এবং বিজয় সম্ভব হবে।
দ্বীন পরিপূর্ণ হওয়া পর্যন্ত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা : বদর যুদ্ধের পরও কাফিরদের প্রচেষ্টা থেমে যায়নি। বরং অব্যাহত রয়েছে আজ পর্যন্ত। এমন একটি দিন কি আমরা অতিক্রম করছি, যে দিনটিতে অন্যায়ভাবে কোনো মুসলমান প্রাণ হারায়নি? পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মুসলমানদের পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। একজন ইরাকি বাবা তার সন্তানের লাশ হাতে নিয়ে বলেছিলেন, আজ পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তু আমার হাতে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই ভারত, মিয়ানমার, কাশ্মির, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, ইরাক, মিসর, সিরিয়াসহ মুসলিম বিশ্বে অসংখ্য মুসলমান প্রাণ হারাচ্ছে। কেন এই দুরবস্থা? কেন আমাদের রক্তের হোলিখেলায় মেতে উঠেছে নিপীড়কগোষ্ঠী? মুুসলিম মিল্লাত কেন আজ চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে?
আসলে আমরা ইসলামের মূল থেকে আদর্শচ্যুত হয়ে গেছি। হৃদয় থেকে উঠে গেছে ঈমানের সঠিক স্পৃহা। আমরা ভুলে গেছি বদর প্রান্তরের শিক্ষা। মনে রাখতে হবে, কাফিরদের পক্ষ থেকে মুসলমানদের দ্বীন থেকে বিরত রাখার অপচেষ্টা চলতে থাকবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বস্তুত তারা তো সর্বদাই তোমাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকবে যাতে করে দ্বীন থেকে তোমাদের পিছিয়ে দিতে পারে যদি সম্ভব হয়।’ (সূরা বাকারাহ :২১৭) এমতাবস্থায় মুমিনদের করণীয় সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা কাফিরদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাও। যতক্ষণ ফেৎনা ফ্যাসাদ ও অরাজকতা দূর না হয় এবং দ্বীন সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়।’ (সূরা আনফাল : ৩৯)
ধৈর্য ও হেকমতসহ সহাবস্থান করা : বর্তমান বিশ্বে ইসলাবিদ্বেষীদের পক্ষ থেকে চলছে চূড়ান্ত জুলুম নির্যাতন। আর মুসলমানরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে নীরবে বসে আছে। তা মোটেও ইসলামের শিক্ষা নয়। বরং উচিত জুলুমের মোকাবেলায় আল্লাহর সাহায্য চাওয়ার পাশাপাশি ধৈর্য, হেকমত অবলম্বনসহ ইসলামের সৌন্দর্যকে গোটা বিশ্বের সামনে তুলে ধরা এবং দ্বীন প্রচারের নিমিত্তে সহাবস্থান করা। তাহলে প্রতিপক্ষ একসময় ইসলামের ছায়াতলে চলে আসবে নতুবা পিছু হটতে বাধ্য হবে।
বদর যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নেয়ার প্রয়োজন থাকবে সব যুগে। দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান শুক্রবার সংঘটিত বদর যুদ্ধের তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, সর্বশক্তিমান আল্লাহ অনুগত বান্দাদের সবসময় সাহায্য করেন, এবং তিনি অহংকারীদের অহংকার চূর্ণ করেন। সূরা লোকমান : ১৭-১৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ( লোকমান আ : তার পুত্রকে সম্বোধন করে বলেছিলেন -) হে বৎস ! সালাত কায়েম করবে, সৎ কর্মের আদেশ দেবে, অসৎ কাজে নিষেধ করবে এবং বিপদে ধৈর্য ধারণ করবে । এটাই দৃঢ় সঙ্কল্পের কাজ। অহংকার বশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে বিচরণ করো না । নিশ্চয় আল্লাহ কোনো উদ্ধত অহংকারীকে পছন্দ করেন না। ”
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বাংলা পোস্ট || প্রকাশক বাংলাদেশ জ্ঞান সৃজনশীল প্রকাশনা ||