ইঞ্জিনিয়ার আবু নোমান হাওলাদার,: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৩তম জন্মবার্ষিকী আজ ( ১৭ই মার্চ-)। একজন ব্যক্তি কীভাবে আপন মহিমায় ইতিহাসের বরপুত্র হয়ে উঠতে পারেন সর্বকালের সেরা বাঙালি বঙ্গবন্ধু তারই উদাহরণ। বীরের জাতি হিসেবে বাঙালির পরিচিতি ছিল সেই বৈদিক যুগেও। গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের সময়ও সমীহ করা হতো এ জাতির সাহস ও বীরত্বকে। তারপর ঘনিয়ে আসে অন্ধকারে ভরা দিন। বাঙালি পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ হয়। সে অভিশপ্ত অধ্যায়ের অবসান ঘটে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। দুনিয়ার ইতিহাসে তাঁর মতো জনপ্রিয় কোনো নেতার অভ্যুদয় হয়নি। ১৯৭০-এর নির্বাচনে বাংলাদেশের দুটি আসন বাদে সব কটিতে জয়ী হয় বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ। কিন্তু কায়েমি স্বার্থবাদ বঙ্গবন্ধুর হাতে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা ছাড়তে রাজি হয়নি। এ অন্যায়ের প্রতিবাদ শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। ১৯৭১ সালের ৩ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর অঙ্গুলি হেলনে পরিচালিত হয় পুরো বাংলাদেশ। সেনানিবাস ছাড়া কোথাও পাকিস্তানি শাসনের অস্তিত্ব ছিল না। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি হত্যায় মেতে উঠলে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চের সূচনালগ্নে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পাকিস্তানি হানাদাররা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। তবে আগেভাগে তাঁর দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। পাকিস্তানি দখলদাররা মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর। বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার ২৪ দিন পর পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। দেশ পুনর্গঠনে নেমে পড়েন শূন্য অবস্থা থেকে।
জাতির পিতা এ দেশের দুখী, শোষিত, বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ’৪৮-এ বাংলা ভাষার দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের পথ বেয়ে ’৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ, ’৫৮-এর মার্শাল ‘ল’ বিরোধী আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন, ’৬৬-এর বাঙালির মুক্তির সনদ খ্যাত ছয়দফা আন্দোলন, ’৬৮-এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ’৬৯-এর রক্তঝরা গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ ও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন প্রভূত ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে বাঙালি জাতি।
বাংলাদেশের আজকের উন্নয়ন ও অগ্রগতির পেছনে রয়েছে মূলত বঙ্গবন্ধুর অবদান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন না হলে এ অর্জন সম্ভব হতো না। স্বাধীনতার পর এ দেশের উন্নয়ন ও পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং তার বাস্তবায়নও শুরু করেন। তিনি শরণার্থী পুনর্বাসন, ভারতীয় মিত্র বাহিনীকে দেশে ফেরত পাঠানো, খাদ্য ঘাটতি দূরীকরণ, প্রশাসনিক কাঠামো গঠন, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় থেকে উপকূলীয় এলাকা রক্ষাকল্পে স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ, আধুনিক শিক্ষা কমিশন গঠন, কৃষি উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণসহ জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের লক্ষ্যে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
দেশের স্বাধীনতাবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে ঘাতকচক্রের হাতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমণ্ডির নিজ বাসভবনে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে শহিদ হন। দেশি-বিদেশি চক্রান্তের সামনেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন নির্ভীক। নিজের জীবনের জন্য তিনি কখনো ভীত ছিলেন না। তিনি বাংলার মানুষকে অনেক ভালোবাসতে আর তাই নিজের জীবন দিয়ে ভালোবাসার মূল্য দিয়েছেন তিনি।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ইতিহাসের এই নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডটি ছিল একটি সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ। সদ্য স্বাধীন দেশ গঠনে যখন সরকার ব্যস্ত, তখনই হত্যা করা হলো দেশের স্থপতিকে। এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ছিল দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার নীলনকশা। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় চায়নি, বাংলাদেশের এমন শত্রু কম ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের বাইরে যেমন প্রত্যক্ষ শত্রুরা ছিল, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের ভেতরেও তার আদর্শ ও লক্ষ্যের প্রচ্ছন্ন বিরোধীদের শক্ত অবস্থান ছিল। দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীদের মদদে এ দেশেরই কিছু দুর্বৃত্ত নৃশংসভাবে হত্যা করে জাতির জনককে। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘটনা কেবলমাত্র এক ব্যক্তিকেই হত্যার প্রয়াস ছিল না, ছিল জাতির স্বাধীনতার শক্তিকে হত্যার অপচেষ্টা। ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে খুন করে তারা একটি আদর্শকে খুন করতে চেয়েছিল। কিন্তু মুজিবাদর্শের বাংলাদেশকে তাঁর স্বপ্ন থেকে বিচ্যুত করা যায়নি। স্বাধীনতার আদর্শকে নিরঙ্কুশ করতে এখন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়ন করতে হবে। বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলার কাজে অধিকতর মনোনিবেশ করতে হবে। যখন বিশ্বজুড়ে সুবিধাবাদী রাজনৈতিক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, সংকীর্ণ রাজনৈতিক মতবাদ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে তখন বঙ্গবন্ধুর মতো একজন মহান নেতার ত্যাগের আদর্শ বাস্তবায়নে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
পরিশেষে বলছি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথিকৃৎ বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির এক অবিসংবাদিত নেতা। তিনি বাঙালির অধিকার এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদান রেখেছেন। শুধু স্বাধীনতা অর্জনই নয়, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা করতে তিনি নিরলস প্রচেষ্টা চালান। বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতির জনকের অবদান তাই চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ারই চেষ্টা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অজেয় আদর্শ পরাভূত করতে পারেনি ’৭৫-এর খুনিরা। বঙ্গবন্ধু আরও উজ্জ্বলভাবে প্রতিস্থাপিত হয়েছেন বাঙালির হৃদয়ে। বাঙালির হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু আছেন বলেই ফিনিক্স পাখির মতো ভস্ম থেকে উড়াল দেওয়ার সাহস দেখাচ্ছে ১৮ কোটি মানুষের এ জাতি। জন্মদিনে জাতির পিতার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) সোহরাওয়ার্দী হল শাখার সাবেক ভিপি, ভোলা-৩ (লালমোহন-তজুমদ্দিন) আসনের আওয়ামী লীগ নেতা ও বিবিএস গ্রুপ এবং নাহী গ্রুপের চেয়ারম্যান।