।। এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া।।
রাজনীতির নোংরা ও স্বার্থপতা এতটাই কঠিন যে, সত্যিকারের ত্যাগি রাজনীতিকদের তিলে তিলে তা শেষ করে দেয়। রাজনিতিতে নতুন কোন সাথিকে যখন পথ দেখাবেন সে মনে করে আপনার চাইতে সে যোগ্য আর সেই কারণেই আপনি তাকে পথ দেখিয়েছেন। তার পর আপনার পতনের জন্য যা যা করা প্রয়োজন তা করতে থাকবে। তাকে পথ দেখাতে গিয়ে যে পুরানো বন্ধুরা আপনার শত্রু হলো এবং আপনাকে পথহারা করতে আপনার চরিত্র হনন থেকে শুরু করে যে সব কাজ করেছিল। আপনার নতুন বন্ধু সেই সব অভিযোগগুলো প্রতিষ্ঠিত করতে যা করার দরকার তাই করে থাকে।
আবার দলের জন্য যে সময়, মেধা, জীবনের যৌবনের সর্বশ্রেষ্ট সময় ব্যায় করলেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করে আপনি বোকা তাই করেছেন। তাতে তাদের কি করার আছে। আপনার জন্মই হয়েছে এটা করার জন্য। আর তাদের জন্ম হয়েছে ক্ষমতার মসনদ ভোগ করার জন্য। তাই ক্ষমতায় যেতে আপনার সকল ত্যাগকে মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পেশে অর্থ-সম্পদের মালিকদের হাতে তুলে দিবে দলের নেতৃত্ব।
বিশিষ্ট আইনজীবী, বিএনপির দু:সময়ে ফাইল হাতে কোর্টের বারান্দায় প্রতিদিন সকাল থেকে উপস্থিত হওয়া মানুষ এডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া তেমনই একজন দুরভাগা রাজনৈতিক নেতা।
গত ১৬ মার্চ ছিল এডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়ার তৃতীয় মৃতু্যবার্ষিকী ছিল। একেবারেই নিরবে কেটে গেল দিনটা। তার প্রাণের দল বিএনপি ও তার হাতে তৈরী করা কোন নেতা কর্মী তাকে স্মরণ করেছে বলে আমার দৃষ্টিতে পড়ে নাই।
রাজনৈতিক খেলোয়াড়দের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলই একমাত্র লক্ষ্য হওয়ায় আদর্শ ও নীতিবান রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা দলগুলোর কাছে গুরুত্ব হারিয়েছে। রাজনীতিতে অর্থের প্রভাব মূল হয়ে দাড়াচ্ছে। আর এ কারণেই এডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়ারা জীবনের শেষ প্রান্তে অবহেলা ও অনাদরে পৃথিবী থেকে বিদার নিচ্ছেন। দল এখন আর তাকে স্মরণ করার প্রয়োজনও অনুভব করে না।
গণতন্ত্র বিকাশে সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলের ভূমিকা জরুরি। নির্বাচন হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রাণ। সেই নির্বাচনে এখন বৃহত রাজনৈতিক দলগুলো এখন আর নেতা-কর্মীর রাজনৈতিক,সাংগঠনিক বা ত্যাগের ইতহাসকে গুরুত্ব দেয় না। গুরুত্ব দেয় অর্থকে। ফলে এডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়াদের মত ত্যাগি নেতারা দিনশেষে অবহেলার শিকার হন। আর এর ফলে দলের মধ্যে সুবিধাবাদী নেতৃত্ব শক্তিশালী হয়ে উঠে।
রাজনীতির কল্যাণে স্বার্থেই এডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়াদের মত ত্যাগি রাজনীতিকদের স্মরণ করতে হবে। অন্যথায় ভবিষ্যতে এমন নেতৃত্ব রাজনীতিতে বিড়ল হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশে রাজনীতিতে উদার গণতন্ত্রের উপাদানগুলো অনুপস্থিত। সময়ের প্রয়োজনে এখন মনে হচ্ছে রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পূর্ণ ঢেলে সাজানো দরকার। তানা হলে এডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়াদের মত ত্যাগি রাজনীতিকদের দূরবিন দিয়ে খুজে বের করা সম্ভব হবে না।
দেশ রাজনীতি শূন্য, কোথাও রাজনীতি নাই। য়ার ফলে সানাউল্লাহ মিয়া দলের ও দলের নেতা-কর্মীদের জন্য কাজ করার পরও দিন শেষে বহিরাগত অর্থ-বৃত্তের মালিকরা দলে মনোনয়ন বাগিয়ে নেয়। আর সানাউল্লাহ মিয়ারা হাসপাতালের বিছানার দীর্ঘ নি:শ্বাস ছেড়ে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে। দলের নেতৃত্বই সানাউল্লাহ মিয়াদের নির্মমভাবে হত্যা করে। সুবিধাবাদী ও লোভি নেতৃত্ব সানাউল্লাহ মিয়ার খুনি।
সানাউল্লাহ মিয়া আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে দুনিয়া ত্যাগ করেছেন ৩ বছর হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে সময় চলে যায়। মনে হচ্ছে, এই তো সেদিনও সানাউল্লাহ ভাইয়ের সাথে দেখা হলো রাস্তায়। হেসে হেসে বলছেন ভুইয়া সাহেব চা খান।
সানাউল্লাহ মিয়ার সাথে সম্পর্ক হযেছিল আমার ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর তাঁকে একবার গ্রেফতার করা হয়েছিল। কারাগারেও ছিলেন অনেক দিন।
সম্ভবত ২০০০ সালে তিনি ঢাকা আইনজীবী সমিতির সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিল। তখন অনেকটা তরুণ সানাউল্লাহ মিয়া। ঢাকা আইনজীবী সমিতিতে ব্যাপক জনপ্রিয় ব্যক্তি। একেবারে কাছে থেকে দেখেছিল দেশ, দল ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের জন্য নিবেদিত একজন মানুষকে।
২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বে চার দলীয় জোট ক্ষমতায় এসেছিল। সানাউল্লাহ মিয়া কোর্টে পিপি হতে পারতেন। কিন্তু সরকারি কোন পদ তিনি নেন নি। সাধারণ আইনজীবী হিসাবেই সেবা দিয়ে গেলেন। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারী জরুরী আইনের সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। সরকারি পদবি নিয়ে যারা পিপি-জিপি হয়েছিলেন তারা হারিয়ে গেলেন। তাদের কাউকে সামনের কাতারে দেখা যায়নি। এমন কি খুঁজেও হয়ত পাওয়া যায়নি তাদের। কিন্তু সানাউল্লাহ মিয়ার নেতৃত্বে মাসুদ আহমদ তালুকদার এবং খোরশেদ আলমরা এগিয়ে আসলেন। দলীয় নেতা-কর্মী হলেই হল। কিসের ছুটির দিন, আর কিসের রাত। সানাউল্লাহ মিয়া তাঁর টিম নিয়ে আদালতে হাজির। এজন্য কেই তাঁকে ডেকেছেন বা টাকা পয়সা দিয়েছেন বলে জানা নেই। তবে সানাউল্লাহ মিয়াকে দেখেছি আদালতে নি:স্বার্থভাবে কাজ করতে।
এমনও দেখা গেছে নেতা-কর্মীদের কোর্টে হাজিরার জন্য যে ফরমটি ক্রয় করতে হয়, সেটাও নিজের পকেট থেকে দেন সানাউল্লাহ মিয়া। দলীয় লোকদের মামলায় কেউ তাঁকে টাকা দেয় না। তিনিও কারো কাছে চেয়ে টাকা নেন না। এমন নিবেদিনপ্রাণ আইনজীবী দ্বিতীয়জনকে খুজে পাওয়া কঠিন।
দলের অবহেলা আর অনাদরে হিমালয় সমান কষ্ট নিয়ে সানাউল্লাহ মিয়া দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। ১/১১ এর সময় আবদুল মান্নান ভূইয়াকে বিএনপি থেকে বহিস্কার করা হয়। একই এলাকায় সানাউল্লাহ মিয়ার বাড়ি। সঙ্গত কারণেই এই আসনটিতে তিনি নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগলেন। প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার হলেই তিনি চলে যান নরসিংদীর শিবপুরে। পুরো সপ্তাহে যা আয় করেন, সবই সেখানে খরচ করেন তিনি।
আশা নিয়ে ২০১৮ সালে মনোনয়পত্র কিনেছিলেন। কিন্তু, তাঁর আশায় একেবারে গুড়েবালি ঢেলে দেয় পাশ্ববর্তী এলাকার এক টাকা ওয়ালা। সানাউল্লাহ মিয়ার জায়গায় টাকাওয়ালা মনোনয়ন পেলেন। এতে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন তিনি।
মারা যাবার আগে অনেককেই সানাউল্লাহ মিয়ার বলেছিলেন, তাঁর দু:খ ছিল একটাই। মমোনয়ন দেয় নাই তাতে কোন আফসোস নেই। তবে একটা জায়গায় তাঁর কষ্ট ছিল। তাঁকে কেউ মুখ দিয়ে বলেওনি মনোনয়নটা দিতে পারলাম না। বা এই কারণে আপনাকে দেওয়া গেল না।
এমন কোন বাক্য তিনি কারো নিকট থেকে শুনেন নাই। স্রেফ টয়লেট পেপারের মতাই তাঁকে ছুড়ে ফেলা হল। এটাই ছিল সানাউল্লাহ মিয়ার কষ্ট।
সানাউল্লাহ মিয়া যাদের কর্মী বানালেন, নেতা বানালেন তরাও তো কেউ তার জন্য একটা স্মরণসভার আয়োজন করলো না। এই পরিনতি দেখে আমার বিশ্বাস সানাউল্লাহ মিয়াদের মত আমরাও একদিন অনাদরে, অবহেলায় হারিয়ে যাবো স্মৃতির আড়ালে। সানাউল্লাহ মিয়া হাতের সৃষ্টিই তার চরিত্র হনন বা তার ব্যার্থতা নিয়ে আলোচনা আর সমালোচনায় ব্যা্স্ত থাকবে।
তারা ভুলে যাকে তাদের উত্থানের জন্য এই কাধটা ব্যাবহার হয়েছিল। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়ার নি:স্বার্থ ত্যাগ কবুল করুন।
লেখক: রাজনীতিক ও কলামিস্ট, মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বায়ক, জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন