নিজস্ব প্রতিবেদক
সরকারি দল আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও দলীয় মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু আগে কঠোর সমালোচনা করলেও এখন তারা নির্বাচনি ট্রেনে। ২৮৯ আসনে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে ভোটযুদ্ধে থাকার সব আয়োজন সম্পন্ন করেছেন তারা। অন্যদিকে, জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে তার স্পষ্ট অবস্থান থাকলেও তিনি ও তার অনুসারীরা রয়ে গেলেন ভোটের বাইরে। বৃহস্পতিবারও তিনি মনোনয়ন ফরম নেননি।
সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের ‘সম্মানে’ ফাঁকা রাখা ময়মনসিংহ-৪ আসনে দলের মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আবু মুসা সরকার। ফলে এখন নির্বাচনি ট্রেনে জি এম কাদের, আর ভোটের বাইরে রওশন এরশাদ।
জানা যায়, দলের নিয়ন্ত্রণ ও নির্দিষ্ট আসনে প্রার্থী হওয়া নিয়ে রওশন এরশাদ এবং জি এম কাদেরের মধ্যে বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিনেও গতকাল পর্যন্ত মনোনয়ন ফরমই নেননি রওশন এরশাদ।
এমনকি বুধবার রাতে গুলশানের বাসায় অনুসারীদের নিয়ে বৈঠকের পর রওশন এরশাদ ঘোষণা দেন এবারের নির্বাচনে তিনি অংশ নেবেন না। তিনি বলেন, জাতীয় পার্টি দলের নেতাদের অবমূল্যায়ন করেছে। সাংবাদিকদের রওশন এরশাদ বলেন, ‘আমি দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। এবারও তফসিল ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছি।
নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। ’ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সহযোগিতা না করার কারণে দলের পরীক্ষিত নেতা-কর্মীদের মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, ‘এমন অবস্থায় আমার নির্বাচনে অংশ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ’ দলীয় সূত্র বলছে, রওশন এরশাদ তাঁর ছেলেসহ কয়েকজন অনুসারীর জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু আসনে মনোনয়ন ফরম চেয়েছিলেন। এর মধ্যে পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের রংপুর-৩ আসনটি তাঁর ছেলে সাদের জন্য চান রওশন এরশাদ।
কিন্তু এ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন জি এম কাদের। এ নিয়ে দুই পক্ষই যার যার অবস্থানে অনড় ছিলেন। এরই মধ্যে দলের পক্ষ থেকে ২৮৯টি আসনে দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়েছে। জাতীয় পার্টির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমান সরকারের অধীনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে জি এম কাদেরের বরাবরই অমত ছিল। তিনি বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছেন। কিন্তু রওশন এরশাদ সব সময় বর্তমান সরকারের অধীনে ভোটের পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন। এ নিয়ে শেষ দিকে ‘নানা চাপে’ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন জি এম কাদের। শর্ত দেন দলীয় মনোনয়নে কারও কোনো হস্তক্ষেপ মেনে নেওয়া হবে না। যার পরিপ্রেক্ষিতে সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে ২২ নভেম্বর ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়া হবে বলে জানান জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। এর পাঁচ দিন পর ২৭ নভেম্বর ২৮৭টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। ফাঁকা আসনগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গোপালগঞ্জ-৩, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের সুনামগঞ্জ-৩, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার মতিয়া চৌধুরীর শেরপুর-২ এবং রওশন এরশাদের ময়মনসিংহ-৪ আসন। একাদশ সংসদ নির্বাচনের মাস ছয়েক পর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মারা গেলে জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে বিভেদ শুরু হয়। একদিকে রওশন এরশাদ, অন্যদিকে জি এম কাদের। শেষ পর্যন্ত কাদের পক্ষই ‘লড়াইয়ে’ জেতেন। জি এম কাদের চেয়ারম্যান এবং প্রধান পৃষ্ঠপোষক হন রওশন এরশাদ। তিন বছর পর থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন রওশন এরশাদের নামে গত ৩০ আগস্ট আকস্মিকভাবে দলের কাউন্সিল ডাকা হয়। এর পাল্টা জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরাও রওশনকে বাদ দিয়ে কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা করতে স্পিকারকে চিঠি দেন। দলের এ রকম পরিস্থিতিতে গত ১৪ সেপ্টেম্বর মসিউর রহমান রাঙ্গাকে দলের সভাপতিমন্ডলীসহ সব পদ থেকে অব্যাহতি দেয় জাতীয় পার্টি। প্রায় দুই মাস পার হলেও জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা করার প্রশ্নে স্পিকারের কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় ৩০ অক্টোবর দলটি সংসদ বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে গেজেট প্রকাশ না করা পর্যন্ত তাঁরা সংসদে যোগ দেবেন না বলে জানানো হয়। অবশ্য পরদিনই সংসদ অধিবেশনে তাদের দেখা যায়। এর আগে ২০২২ সালের ৪ অক্টোবর বহিষ্কৃত নেতা জিয়াউল হক মৃধা পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে জি এম কাদেরের দায়িত্ব পালনে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে মামলা করেন। ঢাকার যুগ্ম জেলা জজ মাসুদুল হক গত বছরের ৩০ অক্টোবর এক আদেশে পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে জি এম কাদেরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং দায়িত্ব পালনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেন। পরে ওই আদেশ প্রত্যাহার চেয়ে জি এম কাদেরের করা আবেদন ১৬ নভেম্বর একই আদালত খারিজ করে দেন। চলতি বছরের আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে তিন দিনের জন্য ভারত সফরে যান জি এম কাদের।
তিনি ফেরার আগের দিন ২২ আগস্ট গণমাধ্যমে একটি বিজ্ঞপ্তি আসে। এতে বলা হয়, জি এম কাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ নিজেকে পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন। এ নিয়ে দিনভর নাটকীয়তার পর রওশনপন্থি নেতা গোলাম মসীহ দাবি করেন, এই বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে রওশন এরশাদ কিছুই জানেন না। জাতীয় পার্টির ভিতরের দ্বন্দ্ব নিয়ে রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। সম্প্র্রতি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে ভোটে যাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন রওশন এরশাদ। পার্টির নেতা-কর্মীরা বলছেন, রওশন এরশাদ নির্বাচনে না যাওয়ার মাধ্যমে পার্টিতে দ্বন্দ্বের অবসান হলো। পার্টিতে জি এম কাদেরের একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলো। তবে রওশন এরশাদের অনুসারীদের ভোটের পর পার্টির চেয়ারম্যান দলে ফেরাবেন কি না তা নিয়ে নেতা-কর্মীদের আগ্রহ রয়েছে।