খান মুহাম্মদ রুমেল
রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশই নেননি। অথচ সেই শিক্ষার্থীকে উত্তীর্ণ দেখিয়েছেন সহকারী রেজিস্ট্রার শামসুল হক। শুধু তাই নয়, প্রধান পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের স্বাক্ষর ছাড়াই এক রাতে ফলও প্রকাশ করে দিয়েছেন তিনি। তার এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
তদন্ত কমিটি গঠনের খবর প্রচার করে বেসরকারি টেলিভিশন সময় সংবাদ। আর এতে ভীষণ চটেছেন শামসুল হক। সোজা ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা করে দিয়েছেন শামসুল হক। আসামি করেছেন সময় সংবাদের বার্তা প্রধান মুজতবা দানিশ এবং রংপুর ব্যুরো প্রধান রতন সরকারকে। দৃশ্যপটে এবার হাজির পুলিশ কর্মকর্তারা।
মুজতবা দানিশ যেহেতু ঢাকায় থাকেন, তার ঠিকানা যাচাইয়ের নামে একের পর এক থানা থেকে হয়রানি শুরু করা হলো তাকে। প্রথমে সময় সংবাদে এলো শাহবাগ থানা পুলিশ। তারা কথাবার্তা বলে চলে গেলেন। এর কিছুদিন পর মুজতবা দানিশের বাসায় গিয়ে হাজির রমনা থানা পুলিশ। তারাও প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে গেল।
এর কিছুদিন পর তিনি বাসা বদল করেছেন। এবার তার নতুন বাসায় হাজির হাতিরঝিল থানা পুলিশ। মাঝখানে আরেক দিন অফিসে এসেছিল কলাবাগান থানা পুলিশ। এছাড়া তার রাজশাহীর গ্রামের বাড়িতেও হানা দিয়েছে পুলিশ। অথচ তিনি কিংবা তার পরিবারের কেউ সেখানে থাকেন না, কয়েক দশক ধরে। বুঝুন অবস্থা!
পাঁচটি থানার পুলিশের জানার বিষয়বস্তু কী? শামসুল হকের করা মামলায় যে মুজতবা দানিশের নাম উল্লেখ করেছেন—তার প্রকৃত নাম ঠিকানা জানা। এই নাম ঠিকানা জানার জন্য পাঁচ থানার পুলিশ হয়রান হয়ে গেল, কিন্তু মুজতবা দানিশ প্রতিবারই তাদের সহযোগিতা করেছেন।
বাংলাদেশ ডিজিটাল হয়েছে। এখন আমরা স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে যাত্রা করছি। আগে আমাদের সরকারি দপ্তরে ফাইলপত্র সব গাদাগাদি করে রাখা হতো। সেখান থেকে অনেক ফাইল হারিয়ে যেত। এখন সার্ভার থেকেও হারিয়েও যায়!
ভাবতে খুব ভালো লাগে, পুলিশ অনেক তৎপর হয়েছে এখন। যেকোনো দায়িত্ব তারা সুচারুভাবে পালন করেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এক সাংবাদিকের ঠিকানা যাচাইয়ের নামে তাদের এত তৎপরতা, তাহলে সাগর-রুনি হত্যার আসামি বছরের পর ধরা পড়ে না কেন? মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য এখন পর্যন্ত ৯২ বার সময় নিতে হলো কেন? চলছে ফেব্রুয়ারি মাস। অনেক বছর আগের ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখে হত্যা করা হয়েছিল তাদের।
সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত দুয়েকটা খবরের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় পদ্মা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তোলা হচ্ছে। প্রতিদিন কয়েকশ ট্রাক ও ট্রলিতে করে সেই বালু ও মাটি শহরে নিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে।
বালু তোলার পেছনে আছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও জাসদ নেতা। ট্রাক চলাচলের জন্য নদীতে বাঁধ দিয়ে বানানো হয়েছে দেড় কিলোমিটার কাঁচা মাটির রাস্তা। কোনো রকম ইজারা ছাড়াই চলছে বালু তোলার কাজ।
ভেড়ামারার রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সঙ্গে জাসদের বিরোধ সবচেয়ে বেশি। বিরোধে একাধিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু লুটপাটের বেলায় সকল শত্রুতা ভুলে তারা মিত্র। (প্রথম আলো, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)
এদিকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউকের সার্ভার থেকে ভবন নির্মাণের অনুমোদন সংক্রান্ত প্রায় ৩০ গ্রাহকের নথি গায়েব হয়ে গেছে। কী কারণে এমনটা হলো—দুই মাসেও খুঁজে বের করা যায়নি।
বাংলাদেশ ডিজিটাল হয়েছে। এখন আমরা স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে যাত্রা করছি। আগে আমাদের সরকারি দপ্তরে ফাইলপত্র সব গাদাগাদি করে রাখা হতো। সেখান থেকে অনেক ফাইল হারিয়ে যেত। এখন সার্ভার থেকেও হারিয়েও যায়! ডিজিটাল হওয়ার পর এটাই কি স্মার্টনেসের নমুনা? জানি না। সব হিসাব কি আর আমরা বুঝি?
দুর্নীতি কিংবা অনিয়মের অভিযোগে অনেক কর্মচারীর বিভিন্ন সময় বদলির কথা শুনি আমরা। আচ্ছা বদলি কি কোনো শাস্তি? নাকি বদলি করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়?
যিনি বা যারা দুর্নীতি অনিয়ম করে প্রতিষ্ঠানের বারোটা বাজালেন, তাকে সেই প্রতিষ্ঠানের অন্য জায়গায় কিংবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে বদলি কি সেটার বারোটা বাজানোর লাইসেন্স দেওয়া হয়? এইসব জটিল হিসাব নিকাশ আমরা আসলেই বুঝি না। অবশ্য সবাইকে সব বুঝতেই হবে এমন তো নয়! তবে যারা বোঝার তাদের অবশ্যই বোঝা উচিত। না হলে কিন্তু সামনে সমূহ বিপদ।
আমাদের চির প্রতিদ্বন্দ্বী প্রধান দুটি দল—তুরস্ক সিরিয়ার মানবিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, অন্য ক্ষেত্রেও তেমনটা করবেন বলে খুব আশা রাখতে ইচ্ছে হয়।
আচ্ছা থাক অন্য আলাপে যাই। তুরস্ক সিরিয়া সীমান্তে ভয়াবহ ভূমিকম্প হলো। হাজার হাজার মানুষ মারা গেছেন। আহত হয়েছেন কত মানুষ—কোনো হিসাব নেই। যুদ্ধ-বৈরিতা, শুত্রুতা-মিত্রতা, আপন-পর ভুলে সারা পৃথিবী এই মানবিক বিপর্যয়ে পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে তুরস্ক সিরিয়ার।
বাংলাদেশ থেকেও গিয়েছে উদ্ধারকারী এবং সহায়তাকারী দল। দেশে পালন করা হচ্ছে একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দেশের দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল।
দুই দলেরই পূর্ব ঘোষিত রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। বিএনপির ছিল পদযাত্রা কর্মসূচি। আর আওয়ামী লীগের ছিল নৈরাজ্যের প্রতিবাদে শান্তি সমাবেশ। দুই দলই তাদের কর্মসূচি স্থগিত করেছে।
রাজনীতি আসলে কাদের জন্য? মানুষের জন্য, মানবতার জন্যই তো সবকিছু। আমাদের চির প্রতিদ্বন্দ্বী প্রধান দুটি দল—তুরস্ক সিরিয়ার মানবিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, অন্য ক্ষেত্রেও তেমনটা করবেন বলে খুব আশা রাখতে ইচ্ছে হয়।
মতের অমিল থাকবে, থাকবে কথার বিপরীতে পাল্টা কথা, থাকবে আদর্শগত পার্থক্য। তবে দুর্নীতি অনিয়মের দোসর না হয়ে, রাজনৈতিক দলগুলো দুর্নীতি রোধে একমত হবে। সোচ্চার হবে—এটাই আশা করি। বাংলাদেশটা যে আমাদের সবার কাছে প্রিয়। বড় বেশি প্রিয়।
লেখক : অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর, সময় টিভি