নিজস্ব প্রতিবেদক
স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন হয় গত বছরের ২৫ জুন। এতে দক্ষিণ বাংলার ২১ জেলার মানুষের পদ্মা সেতুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়। তারপরেও যেন স্বপ্নের অপূর্ণতা ছিল। এবার পদ্মা সেতুতে ট্রেনযাত্রায় সেই পূরণ হলো।
মঙ্গলবার ফরিদপুরের ভাঙ্গা স্টেশন থেকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে এ প্রথম পাথরবিহীন রেলপথ পদ্মা সেতু পার হয়ে মাওয়া প্রান্তের স্টেশনে এসে থামে পরীক্ষামূলক চলে ট্রেনটি। মঙ্গলবার দুপুর ১টা ২১ মিনিটে সাত বগির একটি বিশেষ ট্রেন ভাঙ্গা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে মাওয়া স্টেশনের দিকে রওনা দেয়। ২টা ৩৫ মিনিটে ট্রেনটি পদ্মা সেতুর সংযোগ রেলপথে ওঠে। প্রায় ২০ মিনিট সময় লাগে মূল পদ্মা সেতু পাড়ি দিতে। এই ট্রেন ৪২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ৩টা ১৮ মিনিটে মাওয়া স্টেশনে এসে থামে।
ট্রেনটির চালকের আসনে ছিলেন রেলওয়ের লোকোমোটিভ মাস্টার (এএলএম) রবিউল আলম। এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণ বাংলার যোগাযোগের নতুন অধ্যায় রচিত হলো। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের প্রায় ৯ মাস পর রচিত হলো এ মাইলফলক। যদিও বাণিজ্যিকভাবে এ পথ দিয়ে ট্রেন চলাচলের জন্য আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এর আগে দুপুর ১টা ৫ মিনিটে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন উৎসবমুখর পরিবেশে ফরিদপুরের ভাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশনে পরীক্ষামূলক ট্রেনযাত্রার উদ্বোধন করেন। এ সময় রেলমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার স্বপ্ন একটা একটা করে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। তারই অংশ হিসেবে আজ এ ট্রায়াল ট্রেন চলছে। আগামী সেপ্টেম্বরে ভাঙ্গা থেকে ঢাকা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করবে এবং তার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমরা এ ট্রেনকে যশোর পর্যন্ত নিয়ে যাব। তবে তার জন্য আমাদের ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
এ সময় পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পের ব্যবস্থাপক ব্রিগেডিয়ার সাইদ আহমেদ বলেন, প্রকল্পের কাজ শুরু করতে আমাদের তিন মাস দেরি হয়েছিল। তারপরেও সময়মতো কাজ শেষ করতে পারায় আমরা আনন্দিত। এরই মধ্যে আমাদের এই অংশের কাজের ৯২ ভাগ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ প্রকল্প মেয়াদের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।
উদ্বোধনের সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন চিফ হুইপ নূর-ই আলম চৌধুরী, পানি সম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম, সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন অপু, নাহিম রাজ্জাক, মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন, সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি, আবদুস সোবহান গোলাপ। এ ছাড়া ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন, পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
উদ্বোধনের পর আমেরিকার তৈরি ইঞ্জিন আর চীনের তৈরি সাত বগির বিশেষ ট্রেনে করে মাওয়া প্রান্তে যাত্রা শুরু হয়। ট্রেনে রেলমন্ত্রী এবং আমন্ত্রিত অতিথিসহ বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষার্থী, যুব সমাজের প্রতিনিধিরা যাত্রী ছিলেন। এই ট্রেনটির সামনে ছিল ‘গ্যাং কার’। সেখানে অস্থায়ী চেয়ারে সংবাদকর্মীদের বসার ব্যবস্থা ছিল। দুপুর ২টা ৩৫ মিনিটে ট্রেনটি জাজিরায় পদ্মা স্টেশন দিয়ে যাওয়ার সময় কর্মীরা বাংলাদেশ ও চীনের পতাকা হাতে ট্রেনটিকে স্বাগত জানায়। দুপুর ২টা ৪৮ মিনিটে ট্রেনটি খুব ধীর গতিতে পদ্মা সেতুর নিচের ডেকে প্রবেশ করে। এ সময় ট্রেনের ভেতরে দেশাত্মবোধক গান বাজছিল। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে এই প্রথম পাথরবিহীন রেলপথ। ঝমঝম শব্দে ট্রেনটি চললেও সেতুর ওপর রেলপথে সেই শব্দ বিলীন হয়ে যায়। কেবল চাকার সঙ্গে লাইনের ঘর্ষণের একটা শো শো শব্দ আসছিল।
এদিকে ভাঙ্গা স্টেশন থেকে সেতু পর্যন্ত রাস্তার দুই পাড়ে ছিল উৎসুক সাধারণ মানুষের ভিড়। ছিল রেললাইনের পাশে থাকা স্কুলের শিক্ষার্থীরা। তারাও হাত নেড়ে অভিবাদন জানায়। এ ছাড়া লাইনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মীরাও হাত নেড়ে ট্রেনের যাত্রীদের শুভেচ্ছা জানান। দুধের শিশুকে কাঁধে বসিয়ে ট্রেন দেখাতে ছুটতে ছুটতে আসেন এক বাবা। পদ্মা সেতুর ওপরে ওঠা প্রথম ট্রেনটি দেখতে অনেকেই এসেছিলেন মোবাইল ফোন হাতে। কেউ ট্রেনের ভিডিও করছিলেন, কেউ ট্রেনের সঙ্গে তুলছিলেন সেলফি। নারী-পুরুষ-শিশুরা ট্রেনের হুইসেলের শব্দে রেললাইনের পাশে ছুটে আসেন। হাত নেড়ে, চিৎকার করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিলেন তারা। চৈত্রের ভরদুপুরে পুকুরে স্নানে নামা কিশোরের দল ট্রেনের শব্দ পেয়ে ভেজা শরীরে ছুটে আসে রেললাইনের পাশে। এ সময় পুরো এলাকাজুড়ে ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ।
ভাঙ্গা স্টেশন হতে মাওয়া স্টেশন পর্যন্ত দূরত্ব ৪২ কিলোমিটার। প্রথম দিনে ট্রায়াল যাত্রায় দুই ঘণ্টায় এই পথ অতিক্রম করে ট্রেনটি। তবে শুধু মূল সেতু পাড়ি দিতে সময় লাগে প্রায় ২০ মিনিট। প্রথম দিনে ট্রেনের সর্বোচ্চ গতি ছিল ৩০ কিমি। তবে গড়ে ২০ কিমি গতিতে চলেছে ট্রেনটি। ভাঙ্গা হতে মাওয়া পর্যন্ত চারটি স্টেশন ও একটি জংশন স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। সেগুলো হচ্ছে- ভাঙ্গা স্টেশন, ভাঙ্গা জংশন স্টেশন, শিবচর স্টেশন, পদ্মা স্টেশন ও মাওয়া স্টেশন। স্টেশনগুলো এখনও নির্মাণাধীন থাকলেও পরীক্ষামূলক এ যাত্রায় শ্রমিক ও কর্মকর্তারা পতাকা উড়িয়ে ট্রেন যাত্রীদের স্বাগত জানান। পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তের ৪২ নম্বর ও মাওয়া প্রান্তের ১ নম্বর পিয়ারে আতশবাজির মাধ্যমে ট্রেনকে স্বাগত জানানো হয়।
লোকো মাস্টার রবিউল আলম (৪৩) সোমবার রাতেই এই বিশেষ ট্রেনটি সৈয়দপুর থেকে ঈশ্বরদী, পোড়াদাহ, রাজবাড়ী ও ফরিদপুর হয়ে ভাঙ্গা স্টেশনে নিয়ে আসেন। রবিউল আলম বলেন, পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে প্রথম ট্রেন চালাচ্ছি। বিষয়টা ভাবতে সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাকে জানায়। তারপর থেকেই এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলাম। এটি আমার জীবনে অনেক বড় পাওয়া।
যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল মোটরসের নতুন ইঞ্জিনটি চীন থেকে আনা চকচকে লাল-সবুজ সাতটি বগিকে পরীক্ষামূলক যাত্রায় ধীরগতিতে টেনে নিয়ে পদ্মা সেতু পার করে। ট্রেনটির পেছনে আরেকটি ইঞ্জিন জুড়ে দেওয়া ছিল। তবে এ লাইনে ইঞ্জিনটি সর্বোচ্চ ১২০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে বলে জানান প্রকৌশলীরা।
চীনের ঋণ ও সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ঢাকার কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, ঢাকার কেরানীগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুরের ভাঙ্গা, নড়াইল, মাগুরা হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার মূল লাইনসহ ২১৫ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেললাইন তৈরি করা হচ্ছে। ঢাকা থেকে মাওয়া, মাওয়া থেকে ভাঙ্গা এবং ভাঙ্গা থেকে যশোর এই তিন ভাগে প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাল ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন ২০২৪ পর্যন্ত। দুই তলা পদ্মা সেতুর ওপরতলার সড়কপথ গত বছরের ২৫ জুন উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ২০ আগস্ট সেতুর নিচতলায় রেললাইন স্থাপনের কাজ শুরু হয়। সাত মাসের মাথায় গত ৩১ মার্চ সেতুর ওপর রেললাইন তৈরির কাজ শেষ হয়। এই রেললাইনটি পাথরবিহীন (ব্যালাস্টলেস), সেতুর পাটাতনের ওপর ঢালাইয়ের মাধ্যমে স্লিপার বসানো হয়েছে।
পরে মাওয়া প্রান্তে এক ব্রিফিংয়ে রেলমন্ত্রী বলেন, নতুন রেলপথের জন্য চীন থেকে ১০০ কোচ আনা হচ্ছে। ৪৫টি পৌঁছে গেছে, বাকি ৫৫টি শিগগিরই আসবে। গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত এ প্রকল্পের সার্বিক ভৌত অগ্রগতি ৭৪ শতাংশ। ঢাকা-মাওয়া অংশের কাজের অগ্রগতি প্রায় ৭২ শতাংশ এবং মাওয়া-ভাঙ্গা অংশের অগ্রগতি প্রায় ৯১ শতাংশ। ভাঙ্গা-যশোর প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে প্রায় ৬৮ শতাংশ। প্রকল্পের খরচ বাড়ছে কি না এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগামী বছর জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এটা বলা যাবে।