পারভেজ মোশাররফ
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- দুই শিবিরেই যোগাযোগ রেখে চলছে জাতীয় পার্টি (জাপা)। বিএনপি যদি শেষ মুহূর্তে এসে নির্বাচন না করে, তাহলে পরিস্থিতির শুভ লক্ষণ দেখছে না জাতীয় পার্টির ভোট পর্যবেক্ষকদের একটি অংশ। চতুর্থবারও সরকারকে সমর্থন দিয়ে ভোটে যাবে কি না, এ নিয়ে পর্দার আড়ালে হিসাব বুঝে নিচ্ছে দলটি। ধারাবাহিক গত তিনটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভোটে থাকলেও দ্বাদশে হয়তো প্রকাশ্যে নাও থাকতে পারে। অন্যদিকে বিএনপির জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীতে এবার ভিন্ন হিসাব চলছে। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি) নামে আবেদন করা দলটি নিবন্ধন পেলে তারা এককভাবে ভোটে যেতেও প্রস্তুতি নিচ্ছে। আবার সরকার পতনে এক দফার চূড়ান্ত প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে। আন্দোলনে যদি বিএনপি প্রকাশ্যে মাঠে নামে, তাহলে জামায়াত আন্দোলনেই বেশি মনোযোগী হবে। বিএনপি যদি শেষ বেলায় কৌশলী হয়ে ওঠে, তাহলে জামায়াত ভোটের মাঠ ও রাজনীতিকে প্রাধান্য দেবে। এদিকে জামায়াতের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে সখ্য বাড়িয়েছে বিএনপি। চরমোনাই পীরের দলকে জামায়াতের বিকল্প হিসেবেও ভাবছে বিএনপি। দলের বার্তা নিয়ে চরমোনাইয়ের সঙ্গে একটি বৈঠকও করেছে তারা।
অতীতে সারা দেশে জাতীয় পার্টির ৩০০ আসনে নির্বাচন করার প্রার্থী থাকলেও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর তাতে ভাটা পড়েছে। বর্তমানে জাপার একটি অংশ বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে, তারা সরকারের বলয় থেকে বের হতে চাচ্ছে। আরেকটি অংশ সরকারের সঙ্গেই থাকতে চাচ্ছে বলে জাতীয় পার্টির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে। ইতিমধ্যে অনানুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগের কাছে ৮০টি আসন চেয়েছে জাপা। অন্যদিকে আসনের বিষয়ে একই ধারণা দিয়েছে বিএনপিকেও। জয়ের বাতাস যেদিকে ভারী হতে পারে, সেদিকেই পা বাড়াবে জাপা। সম্প্রতি বনানীতে এক অনুষ্ঠানে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, এ মুহূর্তে এককভাবেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছি। এ জন্য ৩০০ আসনে প্রার্থী ঠিক করতে কাজ শুরু করেছি। এরই মধ্যে বেশ কিছু আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী চূড়ান্ত করে তাদের নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে।
এদিকে জাতীয় নির্বাচনের আগে দলীয় ঝামেলা নিয়ে এখনো ভুগছে জাপা। একটি পক্ষ দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের বাইরে বলয় তৈরির চেষ্টা করছে। তারা দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইছে। অন্যদিকে জি এম কাদের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দল পরিচালনা ও নেতাকর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে দলে নতুন বলয় তৈরি করেছেন। এ দূরত্বের মধ্যে নির্বাচনের আগে কোনো বিস্ফোরণও ঘটতে পারে। একাংশ ভেঙে বিএনপির সঙ্গেও যুক্ত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সরকার পতনে এক দফা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে জামায়াত। কোনো আন্তর্জাতিক চাপ বা কৌশল নয়, বিএনপিকেও প্রকাশ্যে মাঠে চাইবে দলটি। আন্দোলনে যদি বিএনপি একমত হয়, তাহলে জোরালো ভূমিকা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবে। বিএনপি যদি পিছু হটে, তাহলে বিডিপি নিবন্ধন পেলে তারা এককভাবে ভোটে যেতেও প্রস্তুতি নিচ্ছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আবারও জোটবদ্ধ হলে দলটির তৃণমূলে প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে জামায়াতের নীতিনির্ধারণী ফোরাম। তাই আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে তারা বিএনপিকেও স্নায়ুচাপে রেখেছে আবার সরকারের সঙ্গেও পর্দার আড়ালে ডোন্ট ডিস্টার্ব নীতি গ্রহণ করে চলছে।
জামায়াতের নির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবি, দলটি বর্তমান সরকারের পরিবর্তনে বেশি মনোযোগী। আবার বিএনপির আন্দোলনের ধীর গতি দেখে ভোটের রাজনীতিতে টিকে থাকতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্য তৈরিতেও একটি অংশ আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে। আওয়ামী লীগ জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনতে পর্দার আড়ালে সঙ্গী হতে আহ্বান করে যাচ্ছে বলেও দলটির নেতারা দাবি করছেন। তবে ভোটে নামিয়ে দিয়ে শেষ সময়ে আওয়ামী লীগ চুক্তি ভঙ্গ করতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে জামায়াতের। আওয়ামী লীগের কোনো ইঙ্গিতকেই বিশ্বাস করছে না দলটি। পরে তারা দুই কূলই হারাতে পারে। হতে পারে বিএনপির চিরশত্রু আবার ভিন্ন নীতির কারণে নিজ দলেও ভাঙন হতে পারে। সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এক দফার আন্দোলনে রাজপথে সাহসিকতার সঙ্গে অগ্রণী ভূমিকা পালন করার জন্য সবাইকে প্রস্তুতি নিতে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এক দফা আন্দোলনের মাধ্যমে কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
তবে রাজনীতি ও ভোটের পলিসিতে জামায়াতকে আর বিশ্বাস করছে না বিএনপি। রয়েছে দূরত্ব। ১০ ডিসেম্বর সমাবেশে ঘোষণা হওয়া ১০ দফার দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের প্রথম কর্মসূচি পালন করে পিছু হটে দলটি। মৌচাক এলাকায় জামায়াতের কর্মসূচিতে বাধা ও গ্রেপ্তার ইস্যুতে বিএনপি থেকে কোনো বিবৃতি না পেয়ে আন্দোলন থেকে একলা চলো নীতি গ্রহণ করে তারা। সেই থেকে ভোটের আগে জামায়াত ইস্যুতে কোনো ভাটা তৈরি হলে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ দিয়ে তার ঘাটতি পূরণের চেষ্টা চলছে। বিএনপি যে আন্দোলন ঘোষণা করবে, তাতে জোটসহ ধর্মীয় জোটকেও পাশে চায়। সম্প্রতি বরিশালে চরমোনাই পীরের সঙ্গে সেখানকার মাহফিলের মেহমানখানায় বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল বৈঠকও করেছে। ওই বৈঠকে দলের ভাবনা ও চরমোনাইকে পাশে চাওয়ার বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয় বলে বিএনপির একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। সম্প্রতি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম চরমোনাই পীরও তার বক্তব্যে নানা ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, চরমোনাই নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের অধীন ছাড়া কোনো তামাশার নির্বাচনে অংশ নেবে না। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। বিগত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচন ও স্থানীয় নির্বাচনে এটি বারবার প্রমাণিত হয়েছে। সরকারকে পদত্যাগ করে, সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে।