মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচ.ডি
বিগত ২০২২ সাল ছিল মূলত ‘খেলা হবে’ বর্ষ। বছরজুড়ে দল-মত নির্বিশেষে অনেকেই খোলা গলায় কখনো হুংকার দিয়ে, কখনো মুচকি হেসে আবার কখনো গোপনে ফিসফিস করে খই ফুটিয়েছেন ‘খেলা হবে’ বলে। বাস্তবে যখন সত্যি সত্যি খেলার সময় হলো, তখন দেখা গেল মাত্র ২০ লাখ টাকার জন্য অলিম্পিক বাছাই পর্ব খেলতে মিয়ানমার যেতে পারেনি বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে ফোন করে জানতে চাওয়া হয়েছে মেয়েদের দল পাঠাতে কত টাকা লাগবে।
জবাবে জাত খেলোয়াড় ‘খেলা হবে’ বলতে পারেননি। বলেছেন, ‘এখন টাকা হলেও আমি দল পাঠাতে পারব না। দেরি হয়ে গেছে। ’ অর্থাৎ খেলা হবে না।
আবার ক্রিকেট জগতের খেলারাম বলেছেন, ২০ লাখ টাকা যে কোনো টিভি চ্যানেল এমনকি একজন ক্রিকেটারই দিয়ে দিতে পারত। টাকার জন্য ২০১৯ সালেও অংশ নেয়নি বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। অথচ ফুটবলের বরপুত্রদের আয়োজনে কিছু দিন আগেই বাংলাদেশের পুরুষদের জাতীয় দলকে অনুশীলনের জন্য পাঠানো হয়েছিল সৌদি আরবের মদিনায়। কিন্তু এই অনুশীলনের পর ফলাফলের দিকে তাকালে দেখা যায়, এ বছর মার্চের শেষে সিলেটে নিজেদের মাঠে ফিফা র্যাংকিংয়ে ৭ ধাপ পিছিয়ে থাকা পূর্ব আফ্রিকার দেশ সিশেলসের (অবস্থান ১৯২) দুটি ম্যাচের একটিতে জয় ও একটিতে পরাজয় মেনে সিরিজে সমতা করেছে বাংলাদেশের জাতীয় দল (অবস্থান ১৯২)।
পুরুষদের তুলনায় নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড়রা বয়সে অনেক ছোট এবং আইনি দৃষ্টিতে অনেকেই শিশু বা ১৮ বছরের কম বয়সী। অথচ এই ছোটদের নিয়ে এককালের ফুটবল মহাতারকা এবং হালের বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের বড় বড় বরপুত্রদের এহেন কান্ডজ্ঞানহীন আচরণ বা ছেলেখেলা গ্রহণযোগ্য নয়।
ছোটদের নিয়ে গেল মাসে বড়দের আরেকটি ছেলেখেলা হলো বগুড়ায়। একটি সরকারি গার্লস স্কুলের ক্লাসরুম পরিষ্কার নিয়ে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীদের মধ্যে ঝামেলা, ঝগড়া বা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। এরপর সর্বনাশা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য দোষারোপ, পাল্টা মন্তব্য ও দোষখন্ডন পর্বের সূত্রপাত ঘটে।
এই পর্যায়ে ছোট মেয়েদের পক্ষে-বিপক্ষে রীতিমতো ঘোষণা দিয়েই যেন যুদ্ধ নামে অভিভাবক, শিক্ষক ও প্রশাসনের বড়রা। জাতি যাদের কাছে সর্বোচ্চ পরিপক্বতা ও ন্যায়বিচার আশা করেন, তাদেরই একজন ছোটদের সামনে নিজের মেয়ের পক্ষে এমন আচরণ করলেন যে, তাকে তার পদ থেকে সরাতে বাধ্য হয় সরকার। অথচ স্কুলের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও স্থানীয় প্রশাসন যদি ছাত্রী বা তাদের অভিভাবকদের মনে নির্ভরতার ভিত্তি তৈরি করতে পারত, তবে অনেক সহজেই হয়তো এই তুচ্ছ ও বিচ্ছিন্ন ঘটনার সহজ ও গ্রহণযোগ্য সমাধান হতো।
জীবনে কবি কাদের নেওয়াজের লেখা ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ শীর্ষক কবিতাটির কথা- যার শুরুতে লেখা ছিল ‘বাদশাহ আলমগীর-কুমারে তাহার পড়াইতো এক মৌলভী দিল্লির’। একদিন সকালে বাদশাহ দেখতে পান তার পুত্র গুরুর চরণে পানি ঢালছে এবং গুরু নিজ হাতে পা পরিষ্কার করছেন। এ দৃশ্য দেখে বাদশাহ এই ভেবে মনঃক্ষুণ হন যে, শিষ্য হয়ে তার পুত্র শুধু পানি ঢালল কেন। তার উচিত ছিল পানি ঢালার পাশাপাশি নিজ হাতে গুরুর পা পরিষ্কার করে দেওয়া। তাই বাদশাহ গুরুকে নিরালায় ডেকে পাঠান এবং রাজপুত্র সৌজন্যের বদলে ‘বেয়াদবি ও গুরুজনে অবহেলা’ শিখছে বলে নিজের মর্মবেদনা প্রকাশ করেন। কবিতার শেষে গুরুর দৃপ্ত কণ্ঠে তাই উচ্চারিত হয় ‘আজ হতে চির উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির, সত্যিই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর’। এ ধরনের জীবনমুখী কবিতা আজ আমাদের বাচ্চাদের পড়ানো হয় কি না জানি না। তবে এ কথা সত্য যে, বাদশাহ আলমগীরের মতো মানসিকতার অভিভাবক আর দেশ ও জনগণের চোখে উচ্চপর্যায়ের দায়িত্বশীল বগুড়ার সেই অভিভাবকের মন-মানসিকতার এহেন বিপরীত অবস্থান শিশুদের জন্যই অশনিসংকেত। বগুড়ার স্কুলছাত্রী কিংবা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত তথাকথিত ছাত্রী নেত্রীদের মন-মানসিকতাও প্রকারান্তরে নীতি ও নৈতিকতার জগতে ভবিষ্যৎ দুর্যোগের পূর্বাভাস। এ ঘটনা সংশ্লিষ্ট আরও দুটি বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। বগুড়ায় সেদিন পালাক্রমে যে ছাত্রীদের ক্লাস পরিষ্কারের দায়িত্ব ছিল, তাদের রোল নম্বর ছিল পঞ্চাশের পরে। অথচ একটি ক্লাসে ২৫ থেকে ৩০ জনের বেশি ছাত্রছাত্রী থাকলে পাঠদান এবং পাঠ গ্রহণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় বলেই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। অন্য বিষয়টি হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাউন্সিলর বা মনস্তত্ত্ববিদ তথা মানসিক বিষয়ে উপদেষ্টার আবশ্যিকতা। উন্নত বিশ্বে এমনকি আমাদের দেশে নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এমন কাউন্সিলর থাকেন যারা মায়ের মমত্ব দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের অভাব-অভিযোগ শোনেন এবং প্রয়োজনীয় প্রেষণা, অনুপ্রেরণা ও উপদেশ দিয়ে সহায়তা করেন। নিজ গৃহে নির্যাতন বা কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগের কথাও ছাত্রছাত্রীরা বিনা বিধায় একজন কাউন্সিলরকে জানাতে পারে। কাউন্সিলর তার প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা ও পরিপক্বতার আলোকে ছাত্রছাত্রীর গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সমস্যার সমাধান করেন। এমনকি অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকাকেও এমন ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। বর্তমান যান্ত্রিক জীবনে এমন আন্তরিক মানবিক ও সংবেদনশীল শিক্ষক বা কাউন্সিলরের তীব্র প্রয়োজন থাকলেও বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই তা অনুপস্থিত।
বগুড়ার ঘটনার পরপরই রাজধানী ঢাকার অদূরে সাভার স্মৃতিসৌধে ফুল বিক্রেতা এক শিশুকে কেন্দ্র করে কেঁপে ওঠে গোটা দেশ। বর্তমানে দেশে দ্রব্যমূল্যের উচ্চ হার এবং নিজের ক্রয়ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা বোঝাতে শিশুটির বাবা কিছু হতাশাজনক বক্তব্য দেন একটি বাংলা দৈনিকের সাভার প্রতিনিধির কাছে। নেপথ্য কারণ বা উদ্দেশ্য কিংবা অসৎ উদ্দেশ্য- যাই থাকুক না কেন, বাস্তবতা হলো সেই সাংবাদিক প্রেরিত খবরটি দেশের একটি দৈনিক পত্রিকা স্বাধীনতা দিবসে (২৬ মার্চ ২০২৩) অনলাইন ভার্সনে প্রকাশ করে। এ সংবাদে স্মৃতিসৌধের গেটে দাঁড়ানো শিশুর ছবি এবং ছবির পাশে তার বাবার দেওয়া বক্তব্য থাকায় অনেকের মতো সরকারও মনে করে যে, পত্রিকাটি প্রকারান্তরে বোঝাতে চেয়েছে, সেই হতাশাজনক বক্তব্যটি সেই শিশুর। এরপর সাংবাদিক আটক, সম্পাদকসহ সেই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা, সাংবাদিককে কারাগারে প্রেরণ, জামিনে মুক্তি, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, শিল্পী সমাজ ও সাংবাদিক মহলের বিবৃতি ও পাল্টা বিবৃতিতে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজপথ, আদালত চত্বর ও প্রেস ক্লাবসহ প্রায় গোটা দেশ। বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা, দূতাবাস এমনকি সরাসরি কিছু দেশও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। অথচ একটি শক্তিশালী প্রেস কাউন্সিল অথবা সাংবাদিকদের একটি ঐক্যবদ্ধ, নিরপেক্ষ, নির্মোহ ও শক্তিশালী সংগঠন সহজেই এই সমস্যার সমাধান এবং দেশের ভাবমূর্তি রক্ষা করতে পারত।
বগুড়া ও সাভারের ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রেই এ দেশের দায়িত্বশীলরা তথা বড়রা শিশুদের অধিকার ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও সংবেদনশীল মনের প্রতি অনাকাক্সিক্ষতভাবে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছেন। কোনোভাবেই ওই শিশুদের নাম বা পিতা-মাতার পরিচয় এভাবে প্রকাশ করা কোনো নীতি-নৈতিকতার পর্যায়ে পড়ে না। এ বয়সে শিশুরা অত্যন্ত সংবেদনশীল মনের অধিকারী হয় এবং সংকটাপন্ন অবস্থায় বিভ্রান্ত হয়ে অঘটন ঘটায়। এমন পরিস্থিতিতে অনেক ক্ষেত্রে আত্মহননের পথে এগিয়ে যাওয়াও অস্বাভাবিক নয়। অথচ এই শিশুদের অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। তাদের বন্ধু ও সহপাঠীদের সঙ্গে মিশতে হবে। অথচ বিনা বিবেচনায় আমরা বড়রা তাদের নাম পরিচয় দেশ তথা বিশ্বব্যাপী প্রকাশ করে দিলাম। এমনকি একটি টেলিভিশন সংবাদে সাভারের শিশুটিকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসা হলো কোনো রাখঢাক ছাড়াই। বগুড়ার শিশুটির নাম ও অভিভাবকের পরিচয় তুলে সহপাঠীদের বক্তব্যও প্রচারিত হয়েছে বেশ কিছু টেলিভিশনে। আর তথাকথিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ-সংক্রান্ত প্রচারণা যে কোনো সুস্থ বিবেককে শঙ্কিত করে তোলে। অথচ ইউনিসেফ তথা জাতিসংঘ ‘গাইড লাইনস ফর জার্নালিস্টস রিপোর্টিং অন চাইল্ড’ শীর্ষক নীতিমালায় ছয়টি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছে। এসব দিকনির্দেশনার ৬ নম্বর ধারায় যে কোনো ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা থাকলে কোনো শিশুর পরিচয় বা ছবি আবছা বা অস্পষ্ট করে প্রকাশেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ইউনিসেফ শিশুদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও প্রচারে করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়গুলোও স্পষ্টত তুলে ধরেছে পরবর্তী অন্যান্য নীতিমালায়। প্রায় একই ধরনের নীতিমালা ও নির্দেশনা প্রণয়ন করেছে চাইল্ড রাইটস ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্কসহ বহু সংগঠন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো এসব নীতিমালার ধারেকাছেও ভিড়বে না- এটাই স্বাভাবিক। তবে মূল গণমাধ্যমে ছোটদের নিয়ে বড়দের এমন ছেলেখেলা সত্যিই দুঃখ ও হতাশাজনক। এমন ছেলেখেলার এখনই অবসান হোক- এটাই প্রত্যাশা।
লেখাটা শেষ করব দুটি বাণী দিয়ে। ৯ এপ্রিল ছিল জার্মান ধর্মযাজক ও নাৎসিবিরোধী চার্চ প্রধান ডিট্রিস বনহোয়েফারের ৭৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। ডিট্রিস বলেছেন, “শিশুদের জন্য বড়রা কোন ধরনের পৃথিবী রেখে যাচ্ছে, সেটাই হলো ন্যায়ভিত্তিক সমাজের মানদন্ড। আর ব্রিটিশ ধনকুবের ও জগৎখ্যাত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভার্জিন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা স্যার রিচার্ড ব্রেনসনের মতে, ‘এই প্রজন্মের আমরা (বড়রা) আমাদের পিতা-মাতার কাছ থেকে খুব সুন্দর একটা পৃথিবী উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি, যা তারা পেয়েছিলেন তাদের পিতা-মাতা থেকে। এখন আমাদের সন্তান বা তাদের সন্তানরা সেই একই বা খুব সুন্দর পৃথিবীর উত্তরাধিকার হবে কি না, তা নির্ভর করছে আমাদের (বড়দের) ওপর। আমরা যেন কোনো অবস্থাতেই সেই প্রজন্ম না হই, যারা সুন্দর পৃথিবী বিনষ্টের জন্য দায়ী। ’
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল : directoradmin2007@gmail.com