সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো তো বটেই, বলা হয় পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও প্রকৃত গণতন্ত্র অনাগত গণতন্ত্র এবং সে গণতন্ত্র কোথাও পূর্ণ নয়, পূর্ণ হয়ও না। তাই গণতন্ত্রের স্বপ্ন স্তিমিত হয় না, এটি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা সবসময়ই অতি তীব্র।
সেই স্বপ্ন থেকেই দেশে দেশে গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলন হয়। শাসক দল চায় ক্ষমতায় থাকতে, বিরোধীপক্ষ চায় ক্ষমতায় যেতে। শাসকের চেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়, বিদ্রোহ হয় এবং হতেই থাকে। বাংলাদেশেও এখন আন্দোলন হচ্ছে এবং প্রতি পাঁচ বছর পরপর যা হয়, সেটাই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলাদেশের নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়ে বিশ্বের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলো সরকার, রাজনীতিক ও সুশীল সমাজ কথা বলছে। অবস্থা এমন হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ের প্রতিটিতেই বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন এবং একে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন, সংগ্রাম হচ্ছে সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠছে এবং নানারকম মুখরোচক উত্তরও পাওয়া যাচ্ছে। প্রবাসী একজন বিএনপি কর্মী সাংবাদিক পরিচয়ে সেখানে নিয়মিত প্রশ্ন করছেন এবং এ নিয়মিত ব্রিফিংটিকে নয়াপল্টনের রিজভী ব্রিফিং পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন।
আগামী নির্বাচন কেন্দ্র করে দেশে একটি রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে এবং রাজপথ ক্রমেই সহিংস হয়ে উঠছে। শাসক দল আওয়ামী লীগ ও ১৪ দল নিজস্ব অবস্থান চূড়ান্ত করে বলেছে নির্বাচন হবে নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায়, তবে সরকার থাকবে শেখ হাসিনার। অন্যদিকে বিএনপিসহ প্রায় ৩৪টি দল সমান্তরাল আন্দোলন করছে এবং তারা একদফার চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু করেছে। এই একদফা হলো শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। পাশাপাশি বিএনপি থেকে সরে গিয়ে আলাদাভাবে মাঠে সক্রিয় জামায়াতে ইসলামীও। এই আন্দোলনের প্রথম পর্ব অতিবাহিত হয়েছে, যা শুরু হয়েছিল গত ১২ জুলাই। এখন বিএনপিসহ তার মিত্ররা পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবে এবং বলা হচ্ছে সেটাও চূড়ান্ত কর্মসূচি। ঢাকাতে বিএনপি যে কটি কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে, প্রতিটির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে আওয়ামী লীগ। এমনকি বিএনপি তারিখ বদলালে আওয়ামী লীগও বদলেছে। এরই ধারাবাহিকতায় এখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল সক্রিয় হয়েছে। বিএনপি ও তাদের মিত্রদের চলমান একদফার আন্দোলনের বিরুদ্ধে এবার জোটগতভাবে রাজপথে কর্মসূচি নিয়ে নেমেছে ১৪ দল। বুধবার থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী এক সপ্তাহ ঢাকায় নানা কর্মসূচি পালন করবে ক্ষমতাসীনদের এই জোট। কর্মসূচির মধ্যে থাকছে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন ও মিছিল। বিএনপি এখন অবাধে মিছিল-মিটিং করছে। পাড়া-মহল্লাকে স্লোগানে প্রকম্পিত করছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছেন, নিয়মতান্ত্রিকভাবে সভা-সমাবেশে বাধা দেওয়া হবে না, তবে সহিংসতা করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একটা সময় এ সুযোগটাও ছিল না। বিএনপি মনে করছে, বিদেশিদের চাপে সরকার নমনীয় হয়েছে।
আসলেই কি বিষয়টি তাই যে, বিদেশিরা এসে আমাদের নির্বাচন, গণতন্ত্র, শাসনব্যবস্থা সহি করে দিয়ে যাবে? বলতে দ্বিধা নেই যে, বিএনপি, বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী এবং তাদের সহযোগীরা এমন একটি কল্পনায় এখন ডুবে আছে। রাজনৈতিক কল্পনার এ প্রবল শক্তি দেশ এবং জাতির জীবনে বারবার দেখা গেছে। ঝগড়া মেটাতে বারবার বিদেশিরা এসেছে, কিন্তু ঝগড়া বন্ধ হওয়া তো দূরের কথা, বরং বিদ্বেষ বেড়েছে।
ক্ষমতার বাইরে থাকলে বিদেশিদের কাছে ক্ষমতায় বসিয়ে দেওয়ার আবদার করা আর ক্ষমতায় থাকলে বিদেশি তৎপরতার তিরস্কার করার রেওয়াজটা চলছে। এর বড় কারণ আস্থার সংকট। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না, আস্থায় নেয় না। বিএনপির আন্দোলন প্রায় পুরোটাই বিদেশি চাপনির্ভর। সরকারও তাই পশ্চিমা ব্লক যদি চাপ দেয় তো চীন রাশিয়াকে নিজের পক্ষে দেখতে চায় আবার পশ্চিমাদেরও পুরোপুরি নাখোশ করতে চায় না। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিদেশিদের চাপ কমে এলে বিএনপির আন্দোলনও ঢিলে হয়ে যাবে।
এই মুহূর্তে বিএনপির কাছে হাতিয়ার হলো মার্কিন ভিসা নীতি। গত মে মাসে এটি ঘোষিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, বাংলাদেশে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায় তারা। আর সেই নির্বাচন যারা বাধাগ্রস্ত করবে তাদের এবং স্বজনদের ভিসা দেওয়া হবে না বা থাকলে বাতিল করা হবে। এই ভিসা নীতিতে উজ্জীবিত হয়ে সরকার পতনের জোরদার আন্দোলন শুরু করেছে বিএনপি।
প্রশ্ন হলো, গণতন্ত্র ও নির্বাচন বাংলাদেশের নিজস্ব বিষয়। অন্যদের চাপে এগুলো কতটা ঠিকভাবে হবে? বিদেশিরা কেন বাংলাদেশের গণতন্ত্র শক্তিশালী করতে এতটা আগ্রহী? পশ্চিমারা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রকে একটা ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছে বিএনপি যে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত বিগত দুটি নির্বাচন একতরফাভাবে হয়েছে এবং সেটা দেশে গণতন্ত্রের পরিসর ব্যাপকভাবে সংকুচিত করেছে এবং সে জায়গা থেকেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি বিশ্বমানের অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রচণ্ড চাপ দিচ্ছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য পশ্চিমা বিশ্বের অব্যাহত চাপ এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে বিরোধী দলগুলোর যুগপৎ আন্দোলন একটা অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে দেশে। কিন্তু ঢাকায় মার্কিন দূত, ইউরোপীয় দেশগুলোর তৎপরতা এবং মার্কিন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশ সফর সরকারের জন্য চাপ হলেও বিএনপির জন্য কতটা সহায়ক হয়েছে সেটা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। বিদেশিরা অবাধ, অংশগ্রহণমূলক এবং সুষ্ঠু নির্বাচন চাইবে, কিন্তু তারা কি বলবে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার হোক? অবশ্য কোনো কোনো বিদেশি মহল থেকে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানেও নির্বাচন চাইছে।
বারবার নির্বাচনের সময় এ অনাস্থার একটি স্থায়ী সমাধান দরকার। রাজনৈতিক সরকারের অধীনে যদি ভালো নির্বাচন না হয়, তাহলে সেই ব্যর্থতার দায় সব রাজনৈতিক দলেরই। সব দেশে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র চলবে এমনটা ভাবা যুক্তিযুক্ত নয়। নব্বইয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর গণতন্ত্র নিয়ে যে উচ্চ আশাবাদ জেগেছিল, সেটা এখন আর নেই। এর বড় প্রধান কারণ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্বের নীতি। তারা নিজেদের জন্য প্রতিষ্ঠিত উন্নত গণতন্ত্র বাকি বিশ্বের কাছে রপ্তানিসামগ্রী হিসেবে বিবেচনা করছে। গণতন্ত্র থাকা না থাকাকে একটি অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করছে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করার পরিবর্তে সেটাকে বানিয়েছে চাপ প্রয়োগের যন্ত্র। গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের বেশি চাপাচাপি করতে গিয়ে ইরাক, লিবিয়া এবং সিরিয়া—এ তিনটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে তুলনামূলকভাবে সেক্যুলার শাসনব্যবস্থা থাকা এ তিনটি দেশ আজ ধ্বংস হয়েছে আমেরিকার কারণে। মানবাধিকার, গণতন্ত্র, নির্বাচন বলে কিছু নেই সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। অথচ সেসব দেশে কোনো চাপ নেই যুক্তরাষ্ট্রের। কারণ হলো পশ্চিমাদের বাণিজ্য স্বার্থ।
বাংলাদেশের মানুষের রুটি-রুজির সংগ্রাম, নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপনের চাওয়ার সঙ্গে পশ্চিমা গণতন্ত্রের মিলন খোঁজা কঠিন। গণতন্ত্রের জন্য মানুষের দাবি পশ্চিমা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের অনুরূপ নয়। ন্যায়বিচার, বৈষম্যমুক্তি, প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের চেয়ে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ গণতন্ত্র নয় বাংলাদেশের মতো দেশের মানুষের কাছে। সেই সংগ্রামটাই মানুষ করতে চায় সবসময়।
এ কথা সত্য যে, আমাদের দেশে রাষ্ট্রক্ষমতা যত কেন্দ্রীভূত হয়েছে, যত সহিংসতা এবং বলপ্রয়োগ বেড়েছে, তত দেশবাসীর মনে নানা রেখাপাত করেছে। যুদ্ধ করে, লাখ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে যে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সে দেশের মানুষকে কেন বারবার একটা নির্বাচনকালীন লড়াই করতে হবে সেটা বোধগম্য নয়। তবে কি স্বাধীনতা যে গণতন্ত্র এনেছে, তা প্রকৃত গণতন্ত্র নয়?
আমাদের প্রকৃত গণতন্ত্র চাই। যে গণতন্ত্র আমাদের চেষ্টায় আসবে। মানুষের নাগরিক মর্যাদা চাই। সব অঞ্চলের সব উন্নয়ন চাই। নারীর মর্যাদা চাই। শিশুকল্যাণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের উন্নতি চাই। মজুরিবৃদ্ধি চাই। শ্রমিকের জীবিকার নিরাপত্তা চাই। কৃষকের জীবনমানের উন্নতি চাই। এসবই সেই অনাগত গণতন্ত্রের প্রতীক। গণতন্ত্রের এ স্বপ্নকে স্বাধীনতা নিশ্চয়ই জিইয়ে রাখবে অযাচিত রাজনৈতিক কলহের বাইরে।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন