ফখরুল ইসলাম খান
পৃথিবীর বিজ্ঞান ভূখণ্ডের বিভিন্ন পরিবেশে ইসলামী উম্মাহর অধিবাস হওয়ার ফলে স্বভাবতই তাদের অনুকূল-প্রতিকূল বিভিন্ন সমস্যা ও পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। কখনো তাদের জীবনে আসে গতি সজীবতা ও প্রাণচাঞ্চল্য। কখনো আবার নেমে আসে সীমাহীন নির্জীবতা অবসাদ ও হীনম্মন্যতা। কখনো শিকার হয় সংঘাত-সংঘর্ষের এবং নিপীড়ন-নির্যাতনের। কখনো বা মোকাবিলা করে তাহজীব-তমদ্দুন ও সভ্যতা-সংস্কৃতির মতো গুরুতর সমস্যার কিংবা বৈষয়িক ও রাজনৈতিক প্ররোচনা-প্রলোভনের। জীবন কখনো হয় সম্পদ প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ, আবার কখনো চরম দৈন্য ও দারিদ্র্যপীড়িত। কখনো তাদের ওপর চেপে বসে কোনো স্বৈরাচারী ও জালিম শাসক। কখনো বা তাদের ভাগ্য নিয়ে পৈশাচিক খেলায় মেতে ওঠে রাজনীতির পাকা খেলোয়াড় দল। এমনি ধরনের আরো অসংখ্য সমস্যা, জটিলতা ও প্রতিকূলতা আছে তাদের ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে। এ সকল সমস্যা, জটিলতা ও প্রতিকূলতার মোকাবিলার জন্যই প্রয়োজন শক্ত ঈমানের। এর প্রতিটি সদস্য ও শ্রেণিকে ত্যাগ ও কুরবানি এবং আনুগত্য ও সম্পর্কের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা। মানুষ বুদ্ধিসর্বস্ব কোনো জীব নয়, নয় প্রাণহীন কোনো যন্ত্র। বরং বুদ্ধি ও হৃদয় বিশ্বাস ও অনুভূতি এবং আনুগত্য ও প্রেমের সমন্বয়েই মানুষের পূর্ণতা। উপরোক্ত সব গুণাবলি পূর্ণতা লাভ করেছেন হজরত ইবরাহিম (আ.) একজন পূর্ণ মানব বা ইনসানে কামেল হিসেবে। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর গোটা জীবনই হচ্ছে ইশক ও মহব্বত এবং প্রেম ও সম্পর্কের এক অত্যুজ্জ্বল আদর্শ। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর তাওহীদবাদী জীবন হলো মানবেতিহাসে এমন এক স্বর্ণোজ্জ্বল নতুন অধ্যায়, যেখানে এসে মানবসভ্যতা ও ইতিহাস এক নতুন বাঁকে মোড় নিয়েছে। হজরত ইবরাহিম (আ.)কে আল্লাহ তায়ালা দিয়েছিলেন এক শাশ্বত বিধান। চিরন্তন নেতৃত্বে ও ইমামতের সম্মান দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগের কথা। আল্লাহর প্রিয়নবী ইবরাহিম (আ.) স্বপ্ন দেখেন কুরবানি করতে। তিনি পশু কুরবানি করলেন একটির পর একটি। কিন্তু যে কুরবানি আল্লাহর নিকট গৃহীত হলো না, হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর নিকট থেকে নির্দেশ পেলেনÑ এমন বস্তু কুরবানি করতে, যা তিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। কী সেই জিনিস? হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু তো তাঁর স্বীয় পুত্র হজরত ইসমাঈল (আ.)। তবুও কি তাঁর প্রতিপালক ইবরাহিম ও হাজেরার পরম আদরের দুলাল ইসমাঈলের কুরবানিই চান? আল্লাহর নির্দেশ ছিল অতি স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন। সন্দেহেরও কোনো অবকাশ ছিল না তাতে। হজরত ইবরাহিম (আ.) বিচলিত না হয়ে আল্লাহর নির্দেশের কথা শিশুপুত্র ইসমাঈলকে জানালেন। পুত্র ইসমাঈল উত্তরে বললেন, হে আমার সম্মানিত পিতা! আপনি যা স্বপ্নে দেখেছেন, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তা পালন করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে অবশ্যই পাবেন। হজরত ইবরাহিম (আ.) স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন, তেমনি পুত্র ইসমাঈল (আ.) নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য সংকল্প ব্যক্ত করলেন। একেই বলে বাপ কা বেটা। মা হাজেরাও স্বেচ্ছায় আদরের সন্তানকে সাজিয়ে দিলেন। পিতা-মাতা, পুত্রের আল্লাহর পথের কুরবানির এ দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে এটাই প্রথম। অবশ্য হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর কুরবানির জন্য তাঁর বংশ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মর্যাদাসম্পন্ন বংশে পরিণত হয়েছিলেন। যে বংশে আবির্ভূত হয়েছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে বেশিসংখ্যক নবী। বালক ইসমাঈলকে হজরত ইবরাহিম (আ.) নিয়ে গেলেন মিনায়, যেখানে বর্তমানে হাজীদের জন্য নির্দিষ্ট করা কুরবানির স্থান। প্রাণপ্রিয় পুত্রকে কুরবানি করতে মনোবল ভেঙে যেতে পারেÑ এমন আশঙ্কায় ইবরাহিম (আ.) তাঁর চক্ষুদ্বয় আবৃত্ত করলেন। যখন পুত্রকে কুরবানি করতে উদ্যত হলেন সাথে সাথে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রিয় নবীদ্বয়ের আনুগত্যে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁদের কুরবানি কবুল করলেন। আনুগত্য ও কর্তব্যপরায়ণতার পুরস্কারস্বরূপ একটি মোটাতাজা পশু (দুম্বা) পাঠিয়ে পুত্রের পরিবর্তে জবাই করার হুকুম প্রদান করলেন। সেই ঘটনাকে সমগ্র ঈমানদার লোকদের স্মরণ রাখার উদ্দেশ্যে সামর্থ্যবান ও মুসলমানদের ওপর আল্লাহর কুরবানিকে ওয়াজিব করে দেন। সেই থেকে সারা বিশ্বে ঈদুল আজহা বা কুরবানির ঈদ উদযাপিত হয়ে আসছে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতিতে ঈদুল আজহা এক ঐতিহ্যময় স্থান দখল করে আছে। ত্যাগ ও কুরবানির মাঝে যে এত আনন্দ, এত খুশি, তা ঈদুল আজহায় আমরা দেখতে পাই। অন্য কোনো উৎসব বা আনন্দ অনুষ্ঠানে উৎসর্গের ভাব-গাম্ভীর্যের এতটা খুশির ঝলক দেখা যায় না। এজন্য ঈদুল আজহাকে উৎসর্গের আনন্দ উৎসব বলা হয়। ঈদকে সত্যিকার অর্থেই আমরা একটা উৎসব বলতে পারি। দুটি ঈদই মুসলমানদের বিশেষ উৎসব, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মদিনা আসার পরপরই আমাদের মহানবী (সা.) ঈদকে কেন প্রতিষ্ঠা করলেন, সেটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং আমাদের ছোট ও বড় সকলেরই ভেবে দেখার বিষয়। মানুষের জীবনে আনন্দের একটা প্রয়োজন আছেÑ একটা দিক আছে। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) হিজরত করে মদীনায় এসে দেখতে পানÑ মদীনাবাসী (যাদের অনেকেই হিজরতের আগে ইসলাম কবুল করে মুসলমান হয়েছিল) দুটি জাতীয় উৎসব পালন করে থাকে। পারসিক প্রভাবে শরতের পূর্ণিমায় ‘নওরোজ’ এবং বসন্তের পূর্ণিমায় ‘মিহিরজান’ নামে জাতীয় উৎসব দুটি তারা বিভিন্ন ধরনের আনন্দ-আহ্লাদ, খেলাধুলা ও কুরুচিপূর্ণ রং-তামাশার মাধ্যমে উদযাপন করতো। এ দুটি উৎসবের মূল উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য কী, তা জানতে চাইলে তারা রাসূল (সা.)কে জানায়, ইসলামের আগে জাহেলিয়াতের যুগে তারা এ উৎসব দুটি এই ধরনের হাসি-মশকরা ও আনন্দ-উল্লাসের মাধ্যমেই উদযাপন করত বিধায় একই প্রথা তাদের মধ্যে তখনো চালু রয়েছে। উল্লেখিত উৎসব দুটির রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার ছিল সম্পূর্ণরূপে ইসলাম পরিপন্থী। শ্রেণি-বৈষম্য, ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে কৃত্রিম পার্থক্য, ঐশ্বর্য, অহমিকা ও অশালীনতার পূর্ণ প্রকাশে অযাচিতরূপে দীপ্ত ছিল এ দুটি উৎসব। ঐ সব উৎসবের সব দিনগুলো সেই রকমভাবে ঐতিহাসিকও নয়। তাৎপর্যময়ও নয়। অতো গুরুত্ত্বপূর্ণ নয়। অনুষ্ঠানগুলোও নৈতিক মানদণ্ডে অতোটা উত্তীর্ণ নয়। আবার শালীনও নয়। শ্রেণি-বৈষম্য, অহমিকা ও অশালীন কর্মকাণ্ডে পরিপূর্ণ এই উৎসব উদযাপন প্রক্রিয়ায় শিউরে উঠলেন ইসলামের নবী (সা.)। ইসলাম কখনোই সমর্থন করে না এরূপ আপত্তিকর, অসামাজিক কর্মকলাপ। ইসলামের দৃষ্টিতে রাজা-প্রজা, ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালোর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য রয়েছে শুধু বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের মধ্যে, সৎ ও অসত্যের মধ্যে। তাছাড়া আল্লাহ তায়ালা মনোনীত একমাত্র দীন, মহান ইসলাম ধর্মে অনুসারীদের অশ্লীল, রুচিহীন কোনো কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ার কোনো অধিকারও নেই। ব্যথিত ও উদ্বিগ্ন রাসূল (সা.) এরশাদ করলেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য এ দুটি দিবস অপেক্ষা শ্রেয়তর ও মহিমাময় দুটি দিবস নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আর সে পুণ্যময় দিবস দুটি হলো ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। অতএব আগের উৎসব দুটি বন্ধ করে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানাদি পালন কর। চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল আরববাসী তথা মুসলমানদের ‘নওরোজ’ ও ‘মিহিরজান’ উৎসব উদযাপন। ইসলামী আদর্শে উজ্জীবিত আরববাসী শুরু করলো ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা উৎসব উদযাপন। শ্রেণি-বৈষম্যবিবর্জিত, পঙ্কিলতা ও অশালীনতামুক্ত সুনির্মল আনন্দ উপভোগ শুরু হলো ঈদুল ফিতরের পুণ্যময় দিবসে। জন্ম নিল একটি সুস্নিগ্ধ, প্রীতিঘন মিলন উৎসব। সেসব দিক থেকেই তিনি ঐ গুলোর পরিবর্তে এই দুই ঈদ চালু করলেন। এতে এটা প্রমাণ করে যে, ইসলাম উৎসবের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করে, যার ফলেই এই ঈদ উৎসব হয়েছে। একজন মুসলমানের জীবনে প্রতি বছর শুধু দুটি ধর্ম উৎসবই আসে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। বর্তমানে আমাদের সমাজে কুরবানির আধ্যাত্মিক দিকটা অনেকাংশে কমে গেছে। এটা যেন একটা প্রথাগত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কে কত বড় পশু কুরবানি দিচ্ছেন, কত টাকা মূল্য দিয়ে কিনেছেন সেটি ইত্যাদি গুঞ্জন সমাজের ঘরে ঘরে, হাটে-বাজারে, অফিস-আদালতে সর্বত্রই শোনা যায়। কিন্তু এই কুরবানির আসল উদ্দেশ্য কীÑ একথা আমরা বেমালুম ভুলে যাই। শুধু বড় বড় পশু জবাই করলেই কুরবানির হক আদায় হলোÑ এমনটা ভাবার কোনো অবকাশ নেই। যেহেতু কুরবানির উদ্দেশ্য মূলত বড় বড় পশু জবাই করা নয়। কুরবানির আসল উদ্দেশ্য আত্মার অন্তরালে বিরাজমান লোভের পশুকে জবাই করা। মনের কুমন্ত্রণা হিংসা-বিদ্বেষ, অহমিকা ইত্যাদি পশুত্বকে বধ করে মনোজগৎকে পবিত্র করা এবং নিজেকে মুত্তাকি বা খোদাভীরু হিসেবে গড়ে তোলাই কুরবানির আসল উদ্দেশ্য। মানব ইতিহাসের সূচনালগ্নে থেকেই সত্য পথ থেকে বিভ্রান্ত করার জন্য অবিরাম চেষ্টা করে আসছে ইবলিস শয়তান। মানুষের ভেতরে সু ও কুÑ দুটি প্রবৃত্তি বর্তমান। ইবলিস সর্বদা চেষ্টা করে চলছে কুপ্রবৃত্তি উসকে দিয়ে মানুষকে সত্যপথ থেকে সরিয়ে দিয়ে নবী-রাসূলের পথ পরিহার করে চলতে। ফলে মানুষকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয় ইবলিস শয়তানের চ্যালেঞ্জের সাথে। শয়তানের এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় জয়ী হতে হলে মানুষকে ত্যাগ ও কুরবানির চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে হবে। ঈদুল আজহা উদযাপনের মধ্য দিয়েই আমরা এই আত্মত্যাগ তথা কুরবানির শিক্ষা লাভ করি। ইসলামী কৃষ্টি কালচার এবং আমাদের সংস্কৃতি সভ্যতাকে ঐতিহ্যময় ও অর্থবহ করে ঈদ। ঈদ সমাজের সার্বিক মানবতাবোধের উন্নতি ও জনকল্যাণকে নিশ্চিত করে। আত্মোৎসর্গের আনন্দঘন আবহে ঈদ আমাদের সমাজকে সৌন্দর্যময় করে তোলে। ঈদুল আজহার এই খুশির দিনে আমরা ইসলামী সংস্কৃতির যুগান্তকারী সৌন্দর্যকে অবলোকন করি। একে অপরের প্রতি সহমর্মী হয়ে উঠি। আমাদের সাংস্কৃতিক সৌন্দর্যবোধকে আরো সার্থক হিসেবে দেখতে পাই। ত্যাগ ও কুরবানির এই অনুষ্ঠানকে সার্থক ও তাৎপর্যময় করে তোলার জন্য সমানভাবে সকল মুসলমানকে প্রত্যয়ী হওয়া প্রয়োজন। বর্ষ পরিক্রমায় ঈদুল আজহা বার বার ঘুরে আসে ত্যাগের মহান বার্তা নিয়ে, হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর অনুসৃত পন্থায় বিশ্বের কোটি কোটি ঈমানদার মুসলমান মহান আল্লাহর পথে সাধ্যানুযায়ী কুরবানির নাজরানা পেশ করেন। নিয়ত যদি বিশুদ্ধ হয়, তাহলে কুরবানি কবুল হবেই। এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। পবিত্র ঈদের সুন্দর ও সুখকর আনন্দের আবহে আমাদের সমাজ থেকে দূরীভূত হোক হিংসা-বিদ্বেষ এবং সকল প্রকার কলুষতামুক্ত হোক সমাজের প্রতিটি মানুষ। মহান আল্লাহ পাক আমাদের হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর আত্মত্যাগের ও কুরবানির মহান দৃষ্টান্ত অনুসরণ ও তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে পথ চলার তাওফিক দিন।
লেখক : সভাপতি, বিশ্বনাথ কেন্দ্রীয় সাহিত্য সংসদ, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, মাসিক বিশ্বনাথ ডাইজেস্ট। বিশ্বনাথ, সিলেট।