মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার
‘উন্নয়ন’ এমন একটি তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ, যার সুনির্দিষ্ট অর্থ নেই। উন্নয়ন ও উন্নয়নের অর্থ, সংজ্ঞা, ধারণার ভিন্নতা দুনিয়া জোড়াই। যার উন্নয়ন যার মতো। একজনের কাছে যা উন্নয়ন, আরেক জনের কাছে তা অবনতি। যদিও উন্নয়নের গূঢ় অর্থ হলো ইতিবাচক উন্নত পরিবর্তনের স্থায়ীত্ব। সেই বিবেচনায় আমরা কোথায় আছি- এককথায় বলা মুশকিল।
সমাজে সব শ্রেণি-পেশার উপার্জন, উপার্জনের বণ্টন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা এক নয়। সম্পদের বরাদ্দ ও ব্যবহারেও তারতম্য। গড় আয়ের দিক থেকে যে সব রাষ্ট্র সমান অবস্থানে রয়েছে, সে সব রাষ্ট্রের জীবন যাত্রার মানে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য বিদ্যমান। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্ম, সুযোগ, বিশুদ্ধ পরিবেশ, নিরাপদ বায়ু ও পানিতেও একের সঙ্গে অন্যের পার্থক্য। আয়ের সাথে উল্লেখিত বিষয়গুলোকে বিশ্লেষণ ও বিচার করে উন্নয়ন নির্ণয় করা হয়। কিন্তু আধুনিক ধারণা অনুযায়ী শুধু উপার্জনের ওপর দারিদ্র্য ও জীবনযাত্রার মান নির্ভর করে না। উন্নত জীবনমানের ক্ষেত্রে উপার্জন ছাড়াও উপার্জন বা আয় ছাড়াও বেশ কিছু বিষয় যুক্ত রয়েছে।
ষাটের দশকে বলা হতো জাতীয় আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তা দেশের দেশের উন্নয়ন হয়। কিন্তু জাতীয় আয় উন্নয়নের প্রকৃত বহন করে না। সত্তরের দশকে জনগণের প্রকৃত কল্যাণ সামনে রেখে প্রবৃদ্ধির পুনর্বন্টনের দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাখ্যা দেয়া হয়, এর পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়ন, রাজনৈতিক উন্নয়ন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গও জুড়ে দেওয়া হয়। আধুনিক বিশ্বের সাধারণ মানুষ স্বাধীনচেতা এবং গণতন্ত্রমনা, রাজনীতিবিদরা চায় রাজনীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপলাভ করুক, শিল্পপতি ও কৃষিবিদরা চায় উৎপাদন বৃদ্ধি লাভ করুক; সর্বোপরি প্রত্যেকেই চায় নিরাপদ সমাজ, শান্তিময় সহাবস্থান।
এখানে একেকজনের ইচ্ছা প্রক্রিয়া, মাধ্যম এবং কৌশল একেক ধরনের। আবার উন্নয়ন ও শান্তিকে একসঙ্গে বিবেচনা করেন অনেকে। যদিও জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন ধারণার ১৭টি অভীষ্টে মানবকল্যাণসহ অনেক বিষয়ের অবতারণা করা হলেও শান্তির বিষয়ে সরাসরি কিছু বলা হয়নি। এক সময় এ অঞ্চলে শান্তি খোঁজা হতো ‘নুন ভাতে‘। পরে তা এলো ‘ডাল-ভাতে’। আসলে নুন, ডাল, মাছ, মাংস দিয়ে প্রকৃত উন্নয়ন-অবনতি সনাক্ত হয় না। দেশ এখন অভাবগ্রস্ত। সামনে কী হবে বলা যাচ্ছে না। তাই বলে মানুষ খেতে পাচ্ছে না, না খেয়ে মরে যাচ্ছে- এ ধরনের প্রচার মোটেই ন্যায্য নয়। মত-পথ, আদর্শ-চেতনা যে কোনো কারণে সরকারকে অপছন্দ হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও অসহ্য লাগতে পারে। সেই স্বাধীনতা ও অধিকার যে কারোই আছে। তাই বলে চলমান উন্নয়নও অসহ্য কেন? উন্নয়নে অসহিষ্ণুতা কি সুস্থতা? কে না জানে বর্তমান সরকার দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকায় উন্নয়ন অবিরাম দৃশ্যমান হচ্ছে। দুর্নীতি, সুশাসনের অভাবসহ কিছু বিষয় নিয়ে অতৃপ্তি আছে অনেকের। শান্তি ও ন্যায়বিচার বা ন্যায্যতার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারেনি। বাংলাদেশের যেকোনো ভালো প্রস্তাব কার্যকর করার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক দুর্বলতা রয়েছে। প্রশাসনিক দক্ষতার ঘাটতির পাশাপাশি সুশাসন নিয়েও হাহাকার রয়েছে। এর বিপরীতে অর্জনও একেবারে কম নয়। ২০০৯ সালে বিশ্বমন্দা ও চরম খাদ্যাভাবকে সঙ্গী করে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতাসীন হন শেখ হাসিনা। এরইমধ্যে দেশ আবারও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। আওয়ামী লীগ ১২ বছর অর্থাৎ দেশের সবচেয়ে বেশি সময় ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় রয়েছে।
জাতিসংঘ ২০১৫ সালে এসডিজি গ্রহণ করে। এটি ১৫ বছর মেয়াদি। এর উদ্দেশ্য ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা। সেই লক্ষ্যে ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। আর ১৬৯টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। জাতিসংঘ এর আগে সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) গ্রহণ করেছিল। এরপরই এসডিজি আসে। এসডিজির লক্ষ্যগুলোর মধ্যে দারিদ্র্য দূর করা, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সুস্বাস্থ্য, উন্নত শিক্ষা নিশ্চিত ও লিঙ্গবৈষম্য প্রতিরোধ অন্যতম। ২০১৫ সালে এসডিজি গৃহীত হওয়ার পর এই প্রথম এর সূচকের স্কোর আগের বছরের চেয়ে কমে গেছে। এর কারণ হলো কোভিড মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য এবং বেকারত্ব বেড়ে যাওয়া। বিশ্বের অপরাপর দেশের মতো বাংলাদেশও কোভিড মোকাবিলায় কঠিন সময় পার করছে। এর মধ্যেও বাংলাদেশ অনেক সামাজিক সূচকেই ইতিবাচক ধারা বজায় রেখেছে। সামাজিক বিভিন্ন অগ্রগতির সূচকে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিবিড় সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, ক্ষুদ্রঋণের ব্যবহার এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে তার ভূমিকা, বৃক্ষরোপণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকের ইতিবাচক পরিবর্তন প্রশংসিত। সাম্প্রতিক সময়ে এর বেশ ব্যত্যয় ঘটছে। রাজনৈতিক-সামাজিক অস্থিরতায় অনেক অর্জন থমকে যাওয়ার শঙ্কা ঘুরছে।
বৈশ্বিক মহামারি করোনার মাঝেও বাংলাদেশের অর্থনীতিকে গতিময় রাখা শেখ হাসিনার সরকারের আরেক মিরাকল সাফল্য। ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই আর আগের মতো করতে হয় না। বরং জীবনকে বিচিত্র রকম বা ধরনে সাজাতে বড় উৎসুক সাধারণ মানুষ। কারণ তাদের ক্রয় ক্ষমতা আগে চেয়ে বেড়েছে। বেশ কিছু সূচকের উজ্জ্বলতা রয়েছে। বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতি যে ভাবে চাঙ্গা হয়েছে তা ধারনাকে হার মানানো। আশপাশের কোনো কোনো দেশের কাছেও এটি ঈর্ষনীয়। মহামারি-মন্দার মাঝেও পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুকেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা মেট্রোরেল, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পের কাজ থেমে থাকেনি। যার সুবাদে একটির পর একটি দৃশ্যমান হচ্ছে।
উন্নয়নে রকমফের থাকে। এর দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান দুটি দিকও থাকে। উন্নয়ন স্বীকার-অস্বীকারের বিষয় নয়। কেউ অস্বীকার করলে উন্নয়ন বরবাদ হয়ে যাবে, বা স্বীকার করলে তা কয়েকগুন বেড়ে যাবে-এমন নয়। তবে জোর করে অস্বীকার বা জবরদস্তিমূলকভাকে স্বীকারে বাধ্য করা নিয়ে বাধছে গোলমাল।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বাংলা পোস্ট – প্রকাশক বাংলাদেশ জ্ঞান সৃজনশীল প্রকাশনা