মুফতি শামসুদ্দীন জিয়া। দেশবরেণ্য ইসলামি আইনবিদ ও আধ্যাত্মিক রাহবার। চট্টগ্রামের পটিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন দীর্ঘ চার দশক ধরে। আদর্শবান ছাত্র গড়ার ক্ষেত্রে যেমন তার রয়েছে অবদান, তেমনই যুগজিজ্ঞাসার জবাবদানে সক্ষম প্রাজ্ঞ মুফতি হিসেবে রয়েছে ঈর্ষণীয় গ্রহণযোগ্যতা। অত্যন্ত সাদাসিধে জীবনের অধিকারী আলোকিত মানুষ তিনি। লিখেছেন ইজাজুল হক।
ইসলামি জ্ঞান ও শুদ্ধ মানুষদের নিত্য স্পর্শ একজন মানুষকে কীভাবে নিখাদ সোনার চেয়েও খাঁটি মানুষে পরিণত করে, তা মুফতি শামসুদ্দীন জিয়াকে দেখলেই বোঝা যায়। পূর্বসূরি আলেমদের যথার্থ প্রতিচ্ছবি তিনি। বিনম্র আচরণ, মার্জিত চলাফেরা, অহংকারশূন্য বলার ঢং, নিবৃত-আয়োজনে জ্ঞানচর্চা এবং রাতের শেষ প্রহরে সৃষ্টিকর্ত আল্লাহর প্রিয় হওয়ার সাধনা তাকে ইলম ও হেদায়েতের আলোর ফোয়ারায় পরিণত করেছে। তিনি যখন কথা বলেন, কোরআনের আয়াত ও হাদিসের বৈচিত্র্যময় বর্ণনা সারি সারি মুক্তোদানার মতো বেরিয়ে আসে। কয়েক মিনিটের কথায়ও একাধিক আয়াত-হাদিস উদ্ধৃত করেন। সেই আলো-ছড়ানো কথামালায় সুরের যন্ত্রণা নেই, শব্দ-বাক্যের অতিরঞ্জন নেই, দুর্বোধ্যতার সংকট নেই। মূল কথাটিই তিনি সরল ব্যঞ্জনায় সহজবোধ্য শব্দে এক অপার্থিব মায়ায় মুড়িয়ে শ্রোতার তৃষাতুর হৃদয়তটে ঢেলে দেন।
যেকোনো যুগজিজ্ঞাসার উপস্থিত জবাবদানে তার জুড়ি মেলা ভার। কোন কিতাবের কোন অধ্যায়ে বিষয়টির আলোচনা রয়েছে, সমকালে কোন ফকিহ (ইসলামি আইনজ্ঞ) কী মত পোষণ করেছেন, এর একটি নির্যাস তুলে ধরতে পারঙ্গম তিনি। সঙ্গে ইসলামি আইন শাস্ত্রের মৌলিক টেক্সটগুলোও তিনি অনর্গল বলে যান। সুপরিসর কক্ষে সারি সারি কিতাবের মধ্যে নিত্য অধ্যয়নরত এই মানুষটির এমন পান্ডিত্য আশ্চর্য হওয়াটাই বরং অস্বাভাবিক।
নিজেই শুধু পড়েন এবং পান্ডিত্য অর্জন করেছেন তা নয়, ছাত্রদেরও ধরিয়ে দেন জ্ঞানের নেশা। চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন, ‘বেশি বেশি পড়, বেশি বেশি প্রশ্ন কর, সৃজনশীল প্রশ্ন করে অতিষ্ঠ কর, আমাকে আটকাও। যার প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি ব্যর্থ হব, সেই আমার আসল ছাত্র, পুরষ্কারযোগ্য।
এভাবেই চার দশকেরও বেশি সময় ধরে অসংখ্য অনুসন্ধিৎসু মননের গবেষক আলেম ও মুফতি তৈরি করে যাচ্ছেন তিনি। জীবনের পড়ন্ত বেলায়ও থেমে নেই তার এই সাধনা। দেশের অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ায় দীর্ঘদিন হাদিসের পাঠদান করছেন। বর্তমানে তিনি মাদ্রাসাটির শায়খে সানি তথা বোখারি শরিফ দ্বিতীয় খণ্ডের শিক্ষক। দেশের প্রথম ফতোয়া বিভাগ হিসেবে যাত্রা করা পটিয়া মাদ্রাসার উচ্চতর ইসলামি আইন গবেষণা বিভাগের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘ তিন যুগ। একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাসচিবের মতো দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রশাসনিক দায়িত্বও পালন করছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। নিজ গ্রামসহ চট্টগ্রামের একাধিক মাদ্রাসার নির্বাহী পরিচালক হিসেবেও এখনো সক্রিয় তিনি। এ ছাড়া কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আল-হাইয়াতুল উলয়া লিল-জামিয়াতিল কওমিয়ার সদস্য, কওমি শিক্ষাবোর্ড ইত্তিহাদুল মাদারিসিল কওমিয়া বাংলাদেশের প্রধান প্রশিক্ষক ও সহকারী প্রধান পরীক্ষক।
তার শিক্ষক জীবনের শুরুটা হয়েছিল কক্সবাজারের মহেশখালীর জামিয়া আরাবিয়া গোরকঘাটায়। শিক্ষক হিসেবে তিনি অনন্য, অতুলনীয়। তার মতো ছাত্রবান্ধব শিক্ষক সচরাচর দেখা যায় না। তার আন্তরিক আলাপনে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। ছাত্রদের সঙ্গে মিশে যান মাটির মানুষের মতো। কাউকে সম্মান দিতেও কখনো দ্বিধা করেন না। মাদ্রাসার পরিবেশে উস্তাদের সামনে ছাত্রদের চেয়ারে বসা যেখানে নিন্দাযোগ্য ভাবা হয়, সেখানে তিনি তার ছাত্রদের চেয়ারে বসিয়েই প্রয়োজনীয় আলাপ সারেন, গল্প করেন। নিচে বসার সুযোগই দেন না।
শুধু শিক্ষাক্ষেত্রেই নয়, ইসলামি আইন, ফতোয়া বিশেষ করে ইসলামি অর্থনীতি নিয়ে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে কাজ করছেন। ইসলামি ফিকহ কমিটি বাংলাদেশ, ইত্তেহাদুল মাদারিসিল কওমিয়া বাংলাদেশের গবেষণা বোর্ড, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার ফতোয়া বিষয়ক কেন্দ্রীয় কমিটি, আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর ফতোয়া বোর্ড, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বাংলাদেশ বসুন্ধরার ফতোয়া বোর্ড এবং জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়া চট্টগ্রামের ফতোয়া বোর্ডে বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন।
কাজের ধারাবাহিকতায় ২০০২ সালে তিনি মালয়েশিয়ায় ইসলামি বীমা ও জীবনবীমা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ নেন। ২০০৯ সালে মক্কায় মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ফিকহ একাডেমির ইসলামি আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ নেন। এর আগে ২০০০ সালে ইত্তিহাদুল মাদারিসের প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা উন্নয়নে ভারত-পাকিস্তানের বিভিন্ন মাদ্রাসা সফর করেন তিনি।
ইসলামি অর্থনীতি, ব্যাংকিং ও জীবনবীমা বিষয়ক একাধিক প্রতিষ্ঠানের শরিয়া উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশের পথিকৃৎ মুফতিদের একজন। বিভিন্ন ব্যাংকের শরিয়া সুপারভাইজরি কমিটিতে দীর্ঘদিন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
শিক্ষকতা ও ইসলামি আইন গবেষণার পাশাপাশি তিনি আত্মশুদ্ধির কঠিন পথও পাড়ি দিয়েছেন বহু দূর। তার মতে অন্তর পরিশুদ্ধ না হলে ইলম, ফিকহ, রচনাকর্ম ইত্যাদিতে কোনো কল্যাণ নেই। তা কেবল ফেতনাই বাড়াবে। এই বোধ তাকে ছাত্র জীবন থেকে আধ্যাত্মিকতার পথে চালিত করে। পটিয়া মাদ্রাসার সাবেক নায়েবে মুহতামিম মাওলানা আলী আহমদ বোয়ালভী (রহ.)-এর সান্নিধ্যে তিনি আধ্যাত্মিকতার সবক নেন। পরবর্তীতে মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর সান্নিধ্যে ছুটে যান। তার তত্ত্বাবধানে সুন্নতের পাবন্দ আল্লাহর বান্দা হওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যান। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি তাকে খেলাফত প্রদান করেন। এর কিছুদিন পর মাওলানা আলী আহমদ বোয়ালভীও তাকে ইজাজত দেন। মাওলানা বোয়ালভীর দুনিয়াবিমুখতা ও সাদাসিধে জীবন মুফতি জিয়ার জীবনে গভীর রেখাপাত করে। এ ছাড়া টেকনাফের মাওলানা ইসহাক সদর সাহেব (রহ.), শায়খ আবদুল হাফিজ মক্কী (রহ.), আল্লামা সুলতান যওক নদভী ও পীর যুলফিকার আহমদ নকশাবন্দির কাছ থেকেও তাসাউফের ইজাজত লাভ করেছেন।
মুফতি জিয়া নিজেকে শুদ্ধ করেই ক্ষ্যান্ত হননি, আলেম, জেনারেল শিক্ষিত ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ইলম ও ফিকহের প্রসার এবং মনশুদ্ধির কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন মাদ্রাসার সভা-সেমিনারে ছাত্র-শিক্ষকদের বিশেষ পাথেয় যেমন জোগান দিচ্ছেন, একইভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আয়োজনে এবং সমাজের শেকড় পর্যায়ের ওয়াজ মাহফিলে কথা বলে মানুষের রুহের খোরাক জোগাচ্ছেন। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ইসলাহি মজলিসগুলোতে তার বয়ান এই পথের পথিকদের আলোর পথ দেখাচ্ছে। ইতিমধ্যে তার আলো-ছড়ানো এসব বয়ানের একাধিক সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। ‘জীবন গড়ার পাথেয়’, ‘আত্মার পাথেয়’, ও ‘মুমিনের সফলতা’ ওই সব রচনার অন্যতম।
লেখালেখিতে নিয়মিত না হলেও তার একাধিক রচনা রয়েছে। প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘নির্বাচিত পঞ্চাশ হাদিস’ (আরবি), ‘সুন্নতে নববি : বাস্তবতা ও গুরুত্ব’ (বাংলা) ও ‘কবর জিয়ারতের মাসায়েল’ (উর্দু)। এ ছাড়া তার ফতোয়াসমগ্রসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পান্ডুলিপি এখনো অপ্রকাশিত।
১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে গ্রামে জন্ম নেওয়া এই মনীষার পড়ালেখার হাতেখড়ি গ্রামের স্কুলে হয়। পঞ্চম শ্রেণি পাস করে কিছুদিন চট্টগ্রামের জামিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়ায় পড়াশোনা করেন। এরপর পটিয়ার কৈয়গ্রাম হেমায়তুল উলুম মাদ্রাসা এবং আনোয়ারার বোয়ালিয়া হোসাইনিয়া এহইয়াউল উলুম মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। এরপর পটিয়া মাদ্রাসা থেকে বোর্ড পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে দাওয়ায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। এরপর একই প্রতিষ্ঠান থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ইফতা শেষ করেন। বাবা কৃষক হলেও পরিবার ও সমাজের ধর্মীয় আবহ এবং বাবার কঠোর শাসন তাকে পড়াশোনায় নিয়মিত হতে সহায়তা করে।
তুখোড় মেধাবী, ধীমান ও সর্বভুক পাঠক হিসেবে মুফতি শামসুদ্দীন জিয়া শুধু দেওবন্দি ধারাকেই অধ্যয়ন করেননি, বরং পূর্বসূরি প্রায় সব বিজ্ঞ আলেমদের রচনাবলি গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন। এ ছাড়া একজন যুগসচেতন মুফতি হিসেবে জাগতিক জ্ঞানের সব শাখার সাধারণ বিষয়গুলোও সাগ্রহে জানার চেষ্টা করেন প্রতিনিয়ত। তার মতে, যুগের সমস্যা ধরতে না পারলে সমাধান বের করবেন কীভাবে। এ কারণেই ফিকহে তিনি তুলনারহিত। যুগের আবেদন ধরতে সক্ষম হয়েছেন। এনেছেন নতুন চিন্তার সুযোগ।
সমকালীন বিষয়ে তিনি মুফতি তকী উসমানির অনুসরণ করেন। ইসলামি জ্ঞানের ধারায় তিনি উপকারী নতুনকে জায়গা দেওয়ার পক্ষপাতী। তবে পুরনোকে বাদ দিয়ে নয়। এ ক্ষেত্রে তিনি মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)-এর সমর্থক। আধ্যাত্মিকতায় তাকে আমরা মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ)-এর প্রতি বেশি বিশ্বস্ত দেখতে পাই। এসব কারণেই মুফতি শামসুদ্দীন জিয়া হয়ে উঠেছেন আমাদের কালের অন্যতম শীর্ষ আলেম, ফকিহ, শিক্ষাবিদ ও আধ্যাত্মিক রাহবার।