মোস্তফা কামাল
দু’পক্ষের অনড় অবস্থানের মাঝেও সংলাপের চাপ। উচ্চচাপ-নিম্নচাপ মিলিয়ে তা দেশি-বিদেশি দুদিক থেকেই। নমুনা বলছে, আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক আরেকটি সংলাপ দেখবে বাংলাদেশ। অনানুষ্ঠানিক হলে কম-বেশি জানবে সংলাপের খবরটি। বলা হয়ে থাকে, দুনিয়ার বহু সমস্যাই সংলাপে সমাধান পেতে পারে। এর দৃষ্টান্তও আছে। কিন্তু, বাংলাদেশে সংলাপের দৃষ্টান্ত একদম উল্টো। সংলাপ নিয়ে আলাপ-প্রলাপ ও আশাবাদ যতো হয়েছে সেই দৃষ্টে ফল আসেনি। বরং সংলাপ পরবর্তীতে বিলাপ করতে হয়েছে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বিদেশিরা পর্যন্ত সংলাপের ব্যবস্থা করেছেন। তাদের মধ্যস্থতায় সংলাপের খবর ও খণ্ডিত দৃশ্যপট মানুষ দেখেছে দর্শকের গ্যালারি থেকে। উপভোগ করেছে সরকারি দল ও বিরোধী দলের এক টেবিলে বসে হাস্যোজ্জ্বল ফটোসেশন। এসব সংলাপে সংকট নিরসনের দৃষ্টান্ত নেই। উপরন্তু, বিলাপ পর্ব এসেছে। এরপরও রাজনীতিতে সংলাপ একটি পজেটিভ বিষয়। এর আবেদনও আছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সরকারি দল ও মাঠের বিরোধীদলের মধ্যে সংলাপের তাগিদ এ আবেদনের কারণেই। নির্বাচন কমিশন থেকে সংলাপের দায়িত্ব ও আশা ছেড়ে দিয়েও দুতিন দিন আগে সিইসি আবারো বলেছেন, দুদলকে এক টেবিলে চা খেতে খেতে আলাপ করতে। মানে সংলাপে বসতে।
বাস্তবে সংলাপ সমস্যা নয়। সমস্যা সংলাপের এজেন্ডা বা বিষয়বস্তু নিয়ে। দু’দলের নেতাদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ নয়। তাদের মধ্যে কথা হয়। আড়ালে-আবডালে এক ধরনের সংলাপ হচ্ছেও। দেশে-বিদেশে নানা জায়গায় তারা বসেন, খানাপিনা করেন। এসব খবর গণমাধ্যমে আসে না। না আসার যৌক্তিক অনেক কারণও রয়েছে। এরপরও আনুষ্ঠানিকতার বিষয় রয়েছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়েও সংলাপের তাগিদ দিয়েছেন। বলেছেন, আলোচনার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলের ভেতরে সৃষ্টি হওয়া দূরত্ব দূর করা সম্ভব। তার আশাবাদ বা পরামর্শ অমূলক নয়। সমস্যা তো সংলাপের বিষয় নিয়ে। নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে। দুদলেরই নির্বাচনে জেতার গ্যারান্টি নিয়ে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারানোর মতো ঝুঁকিপূর্ণ পদ্ধতির নির্বাচনে যাবে না। বিএনপির বাসনা নিজেদের ক্ষমতাসীন হওয়া এবং আওয়ামী লীগের করুণ পরিণতি নিশ্চিৎ করা।
এ অবস্থার মাঝেও চেপে ধরার মতো হালহকিকতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণা করেই থেমে নেই, দেশটির প্রতিনিধিরা ঘন ঘন সফরে আসছেন। রাষ্ট্রদূত পিটার হাস প্রায় নিয়মিত দু’দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ইইউ প্রতিনিধিরাও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ প্রশ্নে একাট্টা। এতে অনেকের ধারনা- সমাধান আসুক, না আসুক, ধরন যা-ই হোক সামনে সংলাপ একটা হবে। রাজনীতি সম্পর্কে মোটামুটি ধারনা রাখা ব্যক্তিরাও জানেন, এরকম রাজনৈতিক সংকট সমাধানে ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ঢাকায় এসেছিলেন তখনকার কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টেফান। তখন ক্ষমতায় বিএনপি। তাদের হটাতে আওয়ামী লীগের আন্দোলন তুঙ্গে। কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত হয়ে ঢাকা সফরে আসা অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গভর্নর জেনারেল স্যার নিনিয়ান দু’দলকে আলোচনার টেবিলে বসান। শেষ পর্যন্ত তাতে সমাধান আসেনি।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের বাইরে রেখে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। আন্দোলন অব্যাহত রেখে রাজপথ দখলে রাখে আওয়ামী লীগ। নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারকে সংবিধানভুক্ত করে ২৮ দিন পর ক্ষমতা ছাড়ে বিএনপি। বেনিফিসিয়ারি হয় আওয়ামী লীগ। ওই বছরের জুলাইতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ করে ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা দিয়ে বিদায় নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। সেটাই শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের একমাত্র দৃষ্টান্ত। ওই বছর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর আবার ভর করে অস্থিরতা। আওয়ামী লীগের বিলাপের মাঝে আলাপ-সংলাপে আসেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। কিছু পরামর্শ ও সহনশীলতার তাগিদ দিয়ে যান তিনি। ফলাফল তথৈবচ।
২০০৬ সালে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা দিয়ে চলে যাওয়ার কথা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের। কিন্তু, এর আগে ২০০৪ সালে সংবিধানে একটি সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের চাকরির বয়স বাড়িয়ে তারা একটি ফ্যাকড়া বাধিয়ে দেয়। ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টায় নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার মতলবেই ওই সংশোধনীটি আনে তারা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিতর্কিত হয় তখন। এ নিয়ে দুদলের মহাসচিব আবদুল মান্নান ভুঁইয়া ও আবদুল জলিলের সংলাপ বহুল আলোচিত। শুরুতে একটুআধটু আশাবাদ দেখা দিলেও পরে দুই আবদুলের প্রলাপ নামে পর্যবসিত হয় সংলাপটি। সবকিছু উপেক্ষা করে তখনকার রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করা হয়। ওই সময় রাজনৈতিক সংকট নিরসনে শুরু হয় বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ। বাংলাদেশে নিযুক্ত তখনকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রেসিয়া বিউটেনিসসহ ঢাকায় নিযুক্ত পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকদের তৎপরতা বাংলাদেশের রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাদের ওই তৎপরতার পরবর্তী পর্ব ওয়ান ইলেভেন, সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। যা বিলাপে ফেলেছে দু’দলকেই। এক পর্যায়ে সেখান থেকে রাজনৈতিক কূটকৌশলে উৎরে গিয়ে মসনদ পায় আওয়ামী লীগ। টিকে আছে এখনো। তারওপর তত্বাবধায়ক বাদ দিয়ে নির্বাচন নিয়ে এসেছে নিজেদের অধীনে। এ বেদনা-বিলাপ থেকে মুক্তি চায় বিএনপি। চায় আবারও তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান ফিরিয়ে আনতে।
নির্বাচনে সাফল্যের প্রশ্নে বিএনপির এ দাবি মেনে নেয়া সরকারের জন্য সুইসাইডাল। কোন দুঃখে আত্মহননের এ পথে যাবে তারা? সরকার-বিএনপিসহ প্রায় সবারই জানা, সংবিধান মতো দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে জিতবে ক্ষমতাসীনরাই। আর চরম ভরাডুবি হবে বিএনপির। মূল সমস্যা এখানেই। ২০১৩ সালে নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটসহ কয়েকটি দলের সহিংস আন্দোলন ঠাণ্ডা করে একটা ফয়সালা দিতে ঢাকা এসেছিলেন জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব বান কি মুনের দূত অস্কার ফার্নান্দেজ ও তারানকো। তারা দুপক্ষকে নিয়ে আলোচনা বসলেও কোনো সমাধান আসেনি। সময়ের ব্যবধানে বিদেশি আলাপ আবারো জোরদার। উদ্দেশ্য সংলাপ। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের সঙ্গে বৈঠকের পর সিইসি কাজী হাবিবুল আওয়াল ভিবষ্যৎবানীর মতো বলেছেন, ডায়ালগ ছাড়া সঙ্কট মীমাংসা হবে না। ডায়ালগ হলে যে সঙ্কট মিটবে সেই গ্যারান্টিও কি আছে? অথবা দৃষ্টান্ত? গ্যারান্টি বা দৃষ্টান্ত কোনোটিই না থাকলেও আবেদন ও আশাবাদ থাকতে সমস্যা নেই। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যেও আনুষ্ঠানিক সংলাপের আলামত খুব ক্ষীণ। এছাড়া, সংলাপের উদ্যোগ কে নেবেন, রেফারি হবেন কে?-এসব প্রশ্নও বেশ প্রাসঙ্গিক। দু’দলের তরফ থেকে যে সংলাপের উদ্যোগ আসছে না তার মূল কারণ: সংলাপ কী ইস্যুতে হবে তা নিয়ে বিপরীত অবস্থান। সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোন ধরণের নির্বাচনী পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করবে না আওয়ামী লীগ। অন্যদিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপি’ও আগ্রহী নয় কোন আলোচনায়। এ অবস্থায় এবারও সংলাপের নামে ঘুরছে প্রলাপ-বিলাপের যথেষ্ট আলামত।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন