মোস্তফা কামাল
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি ব্লিঙ্কেন জানিয়েছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে লেখা শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন ‘জয় বাংলা’ যুক্ত করে। একই সময়ে তার দেশের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ‘মানবাধিকার’ রিপোর্টে জামায়াতে ইসলামীর প্রতি মায়া-মমতা দেখিয়েছে। দেশটির দুদিন আগে-পরের এমনতর ভূমিকা কি কেবল কূটনীতি? নাকি সুপার ডিপ্লোমেসি, অতিকূটনীতি। দু’আনা আওয়ামী লীগ, এক আনা বিএনপি, এক রত্তি জামায়াতসহ নানা পদ মেশানো কোনো সালশা বা তাবিজ-কবজ?
আমেরিকার ‘জয় বাংলা’: কতটা উচ্ছ্বাসের কতটা আশঙ্কার ।
বাংলাদেশের এবারের মহান স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের শুভেচ্ছাপত্রের শেষ লাইনে লেখা: ‘গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে আপনাকে এবং বাংলাদেশের জনগণকে শুভকামনা জানাই, জয় বাংলা।’ বাংলাদেশের অগ্রগতি ও উন্নতি কামনা করে ‘জয় বাংলা’ অভিবাদনে শেষ করা চিঠিটির পূর্ববর্তী অংশও প্রশংসায় ঠাঁসা। শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ এবং মহামারিকালে বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবদানের জন্য উচ্চমার্গের ধন্যবাদ জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এ ছাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ উদারতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে জানিয়ে বাইডেন বলেন, সংকটের টেকসই সমাধান খুঁজে পেতে যুক্তরাষ্ট্র অবিচল অংশীদার হিসেবে পাশে থাকবে।
চিঠির মাঝে এক জায়গায় সামনের দিনের নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে গণতন্ত্র, সমতা, মানবাধিকার এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতি দুই দেশের অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন তো তার শুভেচ্ছার এক জায়গায় উচ্চাশার সঙ্গে এও বলেছেন, শিগগিরই আঞ্চলিক নেতৃত্বশীল হয়ে ওঠবে বাংলাদেশ। কূটনৈতিক ভাষায় এ ধরনের মন্তব্যকে বলা হয় উচ্চশিত প্রশংসা। মেঠো বাংলায় ‘হাওয়া দেয়া’।
যে কারণেই হোক, যে কোনো সমীকরণ মেলাতেই হোক বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চশিত প্রশংসাটির মাঝেই প্রকাশ হলো যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের বৈশ্বিক মানবাধিকার রিপোর্ট। যেখানে রয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপির আনিত অভিযোগের কপি পেস্ট। বিশেষ করে বাকস্বাধীনতা এবং সমাবেশের স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে দলটির অভিযোগকে আমল দেয়া হয়েছে কড়ায়-গণ্ডায়। নতুন ঘটনা হিসেবে যোগ হয়েছে জামায়াতের প্রতি মমত্ব। জামায়াত বা ইসলামপন্থিদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এভাবে ঝুকে পড়ার মাঝে প্রশ্নের সঙ্গে উদ্বেগও অনেকের। আর স্বাধীনতার ৫৩ বছরে দাঁড়িয়ে মার্কিনের এমন ভূমিকা জামায়াতের জন্য এটি কেবল স্বস্তিরই নয়, সামনের দিনগুলোর জন্য এক ধরনের অভয় বার্তা।
কূটনীতির নাড়িনক্ষত্র বোঝা মহলের কাছে এর মধ্যে বিশ্লেষণের অনেক খোরাক। দেশে-দেশে বিশেষ করে আরবীয় দুনিয়ায় বিগত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্র যা করেছে বাংলাদেশেও কি ওই ধরনের কোনো এজেন্ডা রয়েছে তাদের? যুক্তরাষ্ট্র আরব বসন্তে ঢোল বাজিয়েছে। মিশরে সেক্যুলার হোসনি মোবারকের দীর্ঘদিনের শাসনের অবসান ঘটিয়ে ইসলামিক ব্রাদারহুডকে আগে বাড়িয়েছে। আফগানিস্তানকে নিয়ে খেলেছে অনেক দিন। পরে মারও খেয়েছে। আফগানিস্তানে তালেবানকে মদদ দিয়েছে, আবার ক্ষমতা থেকে দূরে রাখার চেষ্টাও করেছে। একপর্যায়ে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়ে তল্পিতল্পা নিয়ে সরতে হয়েছে।
সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের পুরোনো মিত্র পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ডাবল গেম খেলেছে। তারা আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনীকে লজিস্টিকস ও গোয়েন্দা সহায়তা দিয়েছে। একইসঙ্গে তালেবানকেও সমর্থন দিয়েছে। এর আগে, ১৯৭৮ সালে সাওর বিপ্লবের মাধ্যমে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ পাকিস্তানের সহায়তায় আফগানিস্তানের ক্ষমতার তখত পাল্টে দিয়েছিল। অপ্রতিরোধ্য সামরিক শক্তি থাকার পরও বিশ্বজুড়ে মার্কিন অসম লড়াই সময়ের ব্যবধানে ব্যর্থতার পরিহাসে পর্যবশিত হয়েছে। বাংলাদেশকে নিয়েও কি নতুন মোড়কে পুরনো খেলায় নেমেছে? আশপাশের কয়েকটি দেশে যুক্তরাষ্ট্র এখন আবারও শাসনক্ষমতা পাল্টে দেয়ার পুরোনো খেলা দৃশ্যমান। নাগরিক সমাজের ব্যক্তিত্ব, জাতীয় কাঠামো, বিশেষ করে রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রে ঘাপটি মেরে থাকা অনুচরদের এবং গণমাধ্যম ব্যবহার করে খেলা জমানোর একটি নমুনা বাংলাদেশেও বিদ্যমান। সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক জনরোষ এবং আন্দোলন হাজির করা হচ্ছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন। এমন এক সময় তারা জামায়াতে ইসলামীর জন্য সাফাইতে নেমেছে। তাদের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের বৃহত্তম ইসলামি রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর নেতা ও সদস্যরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর হয়রানির কারণে বাক ও সমাবেশের যে সাংবিধানিক স্বাধীনতা প্রয়োগ করতে পারছে না। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল এবং জামায়াত কার্যালয় বন্ধের কথাও এসেছে সেখানে।
নির্বাচন যত এগোচ্ছে খুচরা দলগুলোর কদর-সমাদর তত বাড়ছে। বিশেষ ফ্যাক্টর হয়ে উঠছে দক্ষিণপন্থী কিছু দল। বিএনপি তাদের জোট ভেঙে জামায়াতসহ ছোটদের দূরে সরিয়ে একটা নাটকীয়তা তৈরি করেছে। ইসিতে নিবন্ধিত ৪০টি দলের মধ্যে ধর্মভিত্তিক ইসলামি দল ১০টি। এর মধ্যে ইসলামী আন্দোলন, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত মজলিশসহ কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক দল ৬টি। ভোটের মাঠে এরা ফ্যাক্টর। সামাজিক ও ধর্মীয় ময়দানে তাদের একটা অবস্থান আছে। মসজিদ, মাদ্রাসা ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাদের বেশ গাঁথুনি রয়েছে। কিছু মুসলিম রাষ্ট্রের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ আছে তাদের। জামায়াতবিরোধী আইডেন্টিটিতে তারা সরকারপন্থি সেজেছে। মাঠ রাজনীতি জমলে তাদের জামায়াতের অভিভাবকত্বে নিয়ে যেতে সময় লাগবে না। তাই কিছু দক্ষিণপন্থী দলের জামায়াতবিরোধী কথাবার্তায় জামায়াত উদ্বিগ্ন নয়, বরং পুলকিত। তাদের কাছে এটি মন্দের ভালো।
সামগ্রিক বিচারে তারা একে নিজেদের এক ধরনের জয় ভাবছে। ফ্যাশনের মতো হলেও দাড়ি রাখছে এ প্রজন্মের তরুণ-যুবকরা।
বোরকা _ হিজাবের প্রচলন বেড়েছে। কাউকে দাড়ি রাখা বা বোরকা পরাতে এক সময় অনেক কষ্ট করতে হতো এসব দলের নেতাকর্মীদের। গত কয়েক বছরে কেবল ব্যাংক-বীমা নয়, সাবান-বিস্কুটে পর্যন্ত ইসলাম শব্দ ইম্পোজ হয়েছে। হালাল সাবান, হালাল বিস্কুট, হালাল মাংসসহ কত কী?
ইসলামি বা শরিয়া ব্যাংকিং নিয়ে এখন কোনো সন্দেহ নেই। প্রতিষ্ঠানের নামে সমানে ইসলামি বা আরবি শব্দ যোগ হয়েছে প্রশ্নমুক্তভাবে। জামায়াতি প্রতিষ্ঠান বলে সন্দেহের তীর ছোড়া হয় না। প্রকারান্তরে এগুলো জামায়াতেরই গোল পয়েন্ট। প্রকাশ্যে বিএনপির সঙ্গে তাদের জোট না থাকলেও ‘যুগপৎ আন্দোলন’ নামে জামায়াত দূরে দূরে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে নিজস্ব বোঝাপড়ায়। এমন কঠিন অবস্থার মধ্যে দল তিন ভাগ হয়ে গেছে। এবি পার্টি-বিডিপি নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। সরকারের সঙ্গে ভগ্ন দল দুটির বিশেষ যোগাযোগের অভিযোগ নিয়ে মূল জামায়াত নিশ্চুপ। ভেতরে-ভেতরে নিজস্ব সক্ষমতা বাড়াচ্ছে বিভিন্ন উইংয়ে। সরকার চাইলেই জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে দিতে পারে, কিন্তু কেন করে না তাও জানে। সময় পাল্টালে পরিস্থিতি এমন থাকবে না, তা বিশ্বাসে রেখে কর্মীদের কোনো মতে টিকে থাকার বার্তা দিচ্ছে। দলটির এমন ঝিম মেরে পড়ে থাকার রহস্য মার্কিনি সালশা নীতির মাঝে কিছুটা হলেও লুকানো।
লেখক : বার্তা সম্পাদক বাংলাভিশন