খান মুহাম্মদ রুমেল
জ্বর সেরেছে বেশিদিন হয়নি। শরীর এখনো খুব দুর্বল। উঠে দাঁড়ালেই মাথায় চক্কর দেয়। অল্প একটু হাঁটলেই হাঁপিয়ে উঠতে হয়। মনে হয় ফুসফুস ফেটে বের হয়ে আসবে। চোখ জ্বালা করে সারাক্ষণ। আর ভীষণ রকম তৃষ্ণা পায় সারাক্ষণ। খাবারে কোনো রুচি নেই। যা-ই মুখে দিই, বমি চলে আসে। ডেঙ্গু এত ভয়ঙ্কর কে জানতো? হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছে ছাব্বিশ দিন। আমার দেহটাকে যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়ে প্রাণপণ লড়েছে চিকিৎসা বিজ্ঞান আর এডিস মশার জীবাণু। শেষ পর্যন্ত জীবাণুর পরাজয় হয়েছে ঠিকই। কিন্তু শরীরের ভেতরে-বাইরে ডেঙ্গু তার চিহ্ন রেখে গেছে প্রবল পরাক্রমে।
ভাবছি কলেজে যাবো। বাসায় একা একা শুয়ে বসে থেকে খুব অস্থির লাগে। কোনো একটা বই হাতে নিয়ে পড়তে গেলেও মাথার কোথায় যেন ঝিমঝিম করে। অল্পক্ষণ পরই বইয়ের লেখাগুলো ঝাপসা হয়ে আসে। চোখে নেমে আসে রাজ্যের ঘুম। টেলিভিশন দেখেও মজা পাই না। নিউজ চ্যানেলগুলোয় সব একই খবর। একই ঘটনা নিয়ে খবর তৈরির নামে কচলাকচলি করে সবগুলো চ্যানেল। প্রোগ্রাম চ্যানেলগুলোরও একই অবস্থা। সব বস্তাবচা অনুষ্ঠান। ইউটিউব, নেটফ্লিক্সে কিছু নাটক-সিনেমা দেখার চেষ্টা করেছি। কোথাও মন বসাতে পারিনি ঠিকঠাক। তাই মনে মনে ভাবলাম, কলেজ যাওয়া শুরু করাই ভালো। অন্তত সবার মধ্যে থাকলে মনের স্যাঁতস্যাঁতে ভাবটা যদি একটু কমে! তাছাড়া কথা বলার জন্যও তো মানুষ দরকার। রোজ সকালে জমিরন খালা এসে রান্না করে দিয়ে যায়। তার সঙ্গে তো আর আড্ডা দেওয়ার কিছু নেই। শুধু দরকারি দুয়েকটা কথা ছাড়া। তবে এই মহিলা মনে হয় আমাকে ভালোবাসে। হাসপাতালে থাকার সময় একদিন ভরদুপুরে দেখি আমার খাটের পাশে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে আছে জমিরন খালা। হাতে একটা নীল রঙের পলিথিনে কমলা হলুদ রঙের মাল্টা উঁকি দিচ্ছে। কী যে ভালো লেগেছিল আমার। কী যে ভালো লেগেছিল জমিরন খালাকে দেখে, বলে বোঝাতে পারবো না। আনন্দে জলে চোখ ভরে গিয়েছিল আমার। বয়স্ক মহিলাটা দীর্ঘদিন আমার একলা বাসায় কাজ করে। কখনো তার সঙ্গে প্রয়োজনের বেশি দুটা কথা বলিনি। কখনো ডেকে জিজ্ঞেস করিনি, খালা আপনার শরীরটা কেমন? কখনো জানতে চাইনি, শেরপুরের নালিতাবাড়ির ছায়াঘেরা গ্রাম সোহাগপুরে কে কে আছে আপনার? কখনো জানা হয়নি এতটা বয়স হলেও কেন মানুষের বাসায় কাজ করেন তিনি? তবুও আজ এই হাসপাতালে একলা থাকার কালে এই নারী আমার জন্য মাল্টা কিনে এনে দাঁড়িয়ে আছেন আমার বিছানার সামনে। কেতাদুরস্ত হাসপাতালে তিনি কীভাবে ঢুকেছেন? তাকে দেখে আমার খুব কান্না পায়। জলে ভরে আসে চোখ। ভালোবাসা বোধহয় এমনই। যাকে আমরা গুরুত্ব দিই, যার কাছ থেকে ভালোবাসা প্রাপ্য বলে মনে করি; সেখান থেকে উপেক্ষা ছাড়া কিছুই মেলে না। আর যেখানে কোনো প্রত্যাশা থাকে না, চাওয়া-পাওয়ার হিসেব থাকে না; সেখান থেকে মেলে মনের প্রান্তর ভেসে যাওয়া ভালোবাসা।
পরের দিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে কলেজে যাওয়ার জন্য রেডি হই। সকাল নয়টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তার মোড়ে রিকশার জন্য দাঁড়াতেই দেখি রোদ উঠেছে চড়া হয়ে। আমার চশমা পরা চোখে রোদ ঝিলিক দিয়ে উঠে মাথার ভেতরে গিয়ে তীব্র আঘাত করে। মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। একবার ভাবি বাসায় ফিরে যাই। কিন্তু মনের ভেতর থেকে কেউ বলে, কলেজে গেলেই বরং ভালো লাগবে। ওখানেই শান্তি। বাসায় গেলে আবার সেই একঘেঁয়ে নিরানন্দ জীবন। বাসায় থাকা মানে সময়ের থমকে থাকা। আমার দিকে তাকিয়ে পরিচিত সবজিওয়ালা মিষ্টি করে হাসে। ফ্লেক্সিলোডের দোকানের কিশোর ছেলেটা ছোট্ট করে সালাম দেয়। আমার মন ভালো হতে থাকে। শরীর খারাপ ভাব কাটতে থাকে। একটা খালি রিকশা পেয়ে উঠে বসি। জ্যামের শহরে রিকশা চলে থেমে থেমে। রোদ থেকে বাঁচতে হুড উঠিয়ে দিই। পঁচিশ-তিরিশ মিনিট লাগে কলেজে পৌঁছতে। রিকশা ভাড়া মিটিয়ে কলেজের ছোট্ট মাঠটা পেরোই ধীর পায়ে হেঁটে। টিচার্স লাউঞ্জে পৌঁছে প্রায় সবাইকেই পেয়ে যাই। আকমল ভাইকে দেখি বসে বসে পরীক্ষার খাতা দেখছেন। চোখ তুলে আমার দিকে তাকান। কিন্তু কিছুই বলেন না। আত্মভোলা আকমল ভাই হয়তো জানেনই না, আমি দীর্ঘ ডেঙ্গুর ধকল কাটিয়ে এক মাসের বেশি সময় পর আজকে প্রথম কলেজে এসেছি। বাকিরা সবাই হইহই করে ওঠেন। কাছে এসে কুশল জানতে চান। শরীরের খোঁজ-খবর নেন। বায়োলজির রত্না আপা গলায় বেশ খানিকটা সুর তুলে বলেন, এবার একটা বিয়ে করে ফেলো পাভেল। অসুখে পড়ে দেখলা তো আপনজন কেউ না থাকলে কী মুসিবতের মধ্যে পড়তে হয়! আপার কথা শুনে নিঃশব্দে হাসি। কেমন আছেন আপা? আর আমাদের থাকাথাকি! তোমাকে যেটা বললাম শুনেছো তো? পছন্দের কেউ থাকলে বলো। না হয় আমিই খুঁজে দেবো একটা ভালো মেয়ে। জানো তো, আমার সন্ধানে অনেক মেয়ে আছে। বলে যেতেই থাকেন রত্না আপা। বলতে বলতে চেয়ার ছেড়ে মোবাইল ঘাটতে ঘাটতে এগিয়ে আসেন আমার দিকে। দেখো দেখো, এই মেয়েটা পছন্দ হয় কি না! আমি কোনো কথা বলার আগেই এগিয়ে আসেন ইতিহাসের হাসান ভাই। আহা! কী শুরু করলেন আপা। ছেলেটা অসুখের ধকল সেরে মাত্র এলো। তাকে একটু বসতে দিন।
লাউঞ্জের দক্ষিণ দিকের জানালার কাছের যে চেয়ারটায় আমি নিয়মিত বসি, সেখানে বসে আফজালকে দেখি আমার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছে। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ানোর ভঙ্গি করে। তাকে উঠতে মানা করে আমি পাশের চেয়ারটায় বসি। আর দেখার চেষ্টা করি, গত একমাসে কোনো পরিবর্তন এলো কি না আমাদের টিচার্স লাউঞ্জে। সবই দেখি আগের মতো লাগে। ওই তো আকমল ভাই পরীক্ষার খাতা দেখছেন। আবিদ ভাই বসে মোবাইল ফোনে বাচ্চাদের মতো গেমস খেলছেন। সঞ্জিতদা দাবার বোর্ড সাজিয়ে বসে আছেন পার্টনারের অপেক্ষায়। দরজা দিয়ে ছটফট পায়ে ঢুকছেন সাবিনা আপা এবং রতন ভাই। তারা দুজন স্বামী-স্ত্রী। আরে পাভেল যে! কতদিন পর এলে! শরীর এখন কেমন? বলতে বলতে পাখির ডানার মতো দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে দিয়ে ওড়ার মতো ভঙ্গি করে এগিয়ে আসতে থাকেন আমার দিকে। আমার বড় ভালো লাগতে শুরু করে। এই চেনা মানুষগুলোর ভেতর আছি গেলো সাত বছর ধরে। সুখে দুঃখে আনন্দ বেদনায় এক সঙ্গে আছি। আমার বড় ভালো লাগতে থাকে। যখন হাসপাতালে ছিলাম, প্রায় প্রতিদিন নিয়ম করে দেখতে যেতেন সাবিনা আপা। যদিও আমি কিছুই খেতে পারতাম না, তবুও এটা সেটা নানা খাবার বানিয়ে নিয়ে যেতেন তিনি। হাসপাতালের ঘরে অসুখ অসুখ গন্ধে অস্থির অস্থির করে আপার সাত বছর বয়সী মেয়েটা। তবুও আপা বসে থাকেন ঠাঁয়। নানা কথা বলে, গল্প করে আমার মন ভালো রাখার চেষ্টা করেন। এসব ভালোবাসর ঋণ শোধবার কোনো উপায় আছে কি? আমার জানা নেই। সব ঋণ শোধ করার দরকারই বা কি! থাকুক না কিছু মানুষের কাছে অশোধিত ঋণ!
প্রায় সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় শেষে কোনার দিকের একটা চেয়ারে এসে বসি। বেয়ারা রহিম ভাই এসে এক কাপ চা এনে রাখেন আমার সামনে। সঙ্গে সেদিনের পত্রিকা। পত্রিকাটা একপাশে ঠেলে রেখে চায়ের কাপে চুমুক দিই। এমন সময় খবর আসে প্রিন্সিপ্যাল স্যার ডেকেছেন তার রুমে। স্যারের ওখানে যাওয়ার আগে, উঠে বাথরুমে গিয়ে একটু ফ্রেশ হওয়ার চেষ্টা করি। হাতেমুখে পানি দিই। পাঞ্জাবির ভাঁজগুলো টেনে সোজা করার চেষ্টা করে স্যারের রুমে ঢুকতেই মনটা কেমন যেন শীতল শীতল লাগে। শান্ত সৌম্য চেহারা অধ্যাপক আমিনুল ইসলামের। আপাদমস্তক ভদ্রলোক মানুষ। সারাক্ষণ পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। রুমে ঢুকতেই আমাকে হাত ইশারায় বসতে বলেন। ফোনে কার সঙ্গে যেন কথা বলছেন। স্যারের টেবিলের সামনের চেয়ারে আলতো করে বসি। চোখ চলে যায় স্যারের মাথার পেছনের জানালার দিকে। জানালা গলে একফালি রোদের অর্ধেকটা এসে পড়েছে স্যারের টেবিলে, বাকি আধখানা রোদ বিছিয়ে আছে স্যারের পিঠে এবং মুখের একপাশে। জানালা থেকে হাতখানেক দূরে একটা হাস্নাহেনা গাছ। এই ভরদুপুরেও সতেজ লাগে গাছের ফুলগুলো। একটা মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে আছে ঘরময়। অল্প সময় পরই স্যারের কথা শেষ হয়। অফিস সহকারীকে ডেকে দুইকাপ চা দিতে বলেন। একবার ভাবি বলি, স্যার আমি চা খাবো না। কিন্তু মনে হয় স্যার যখন আগ্রহ করে চায়ের কথা বলছেন, সুতরাং মানা না করাই ভালো। তারপর কেমন পাভেল সাহেব? স্যারের মুখে স্মিত হাসি। ভালো আছি স্যার। আমিও বলি হাসিমুখে। কিন্তু আপনাকে দেখে তো এখনো খুব কাহিল মনে হয়। না, স্যার আমি ঠিকই আছি। শরীরটা একটু দুর্বল আর কি। আরও কিছুদিন বিশ্রাম নিতেন বাসায়। কলেজে আসার খুব দরকার ছিল, তাতো নয়। আমি কিছু না বলে মিষ্টি করে হাসি। চা আসে। দুজনেই নিঃশব্দে চা খাই। সময় যেন কাটছে না। খুব দ্রুত চা শেষ করে ঘর থেকে বের হতে পারলেই বাঁচি। আমার মনের কথা যেন বুঝতে পারেন স্যার। আলতো স্বরে নাম ধরে ডাকেন। পাভেল! জি স্যার। একটু ঢাকার বাইরে যাবেন নাকি? কোথায় স্যার? মিঠামইন কলেজে ভাইভা নেওয়ার জন্য এক্সট্রানাল হিসেবে একজনকে চেয়েছে। কলেজের অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম আমার বন্ধু মানুষ। খুব করে ধরেছে। একজন কাউকে পাঠানোর জন্য। যাবেন নাকি আপনি? একটু ঘুরে আসেন। কাজও হবে, ঘোরাও হবে। হাওর খুব ভালো জায়গা। ফ্রেশ বাতাস। ভালো লাগবে আপনার। যাবো স্যার। কবে যেতে হবে? ১৭ তারিখ ওখানে পরীক্ষা। পরের দিন ভাইভা। আমি স্যার কালই রওয়ানা দিই? টেবিলে রাখা ক্যালেন্ডারের দিকে চোখ রাখেন স্যার। কাল ১৫ তারিখ। চাইলে আপনি একদিন পরেও যেতে পারেন। নাহ স্যার, কালই রওয়ানা দিয়ে দিই। দুদিন একটু ঘুরে টুরে তারপর না হয় কাজ শুরু করবো। আচ্ছা। ঠিক আছে তাহলে। আমি তাহলে যাই স্যার। ঠিক আছে যান। আর শোনেন পাভেল সাহেব, শরীরের দিকে একটু খেয়াল রাখেন। এই বয়সেই এত রোগ-শোক বাঁধালে হবে? কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু একটা হাসি দিয়ে বের হয়ে আসি স্যারের রুম থেকে।
স্যারের রুম থেকে বের হয়ে আসতেই আফজালের সঙ্গে দেখা। পাভেল ভাই চলেন লাঞ্চ করি। চলো! দুজন গিয়ে বসি টিচার্স ক্যান্টিনের এক কোনায়। আফজাল খিচুড়ি অর্ডার করে। খিচুড়ি ছাড়া অন্য কিছু খেতে চাই আমি। কিন্তু নাছোড় আফজাল মনে করে গরুর মাংসের সঙ্গে ঝাল আচার দিয়ে খিচুড়ি খেলেই মুখের স্বাদ ফিরবে। কথা বাড়াতে ইচ্ছে করে না আমার। এই ছেলেটা এমনই। নিজে যা বলবে, তা-ই করে ছাড়বে। অন্যদের সঙ্গে কী করে জানি না। তবে আমার সঙ্গে সব সময় এক ধরনের অধিকার খাটায়। মাঝে মাঝে খুব বিরক্ত লাগে, তার এ রকম একগুঁয়ে আচরণ। কিন্তু ছেলেটা আমার খুব পছন্দের। তাই বিরক্ত হলেও তার প্রতি বেশিক্ষণ রাগ ধরে রাখতে পারি না। আফজাল, কাল আমি কিশোরগঞ্জ যাচ্ছি! কিশোরগঞ্জ কোথায়? কেন যাচ্ছেন? আপনি না বললেন শরীর এখনো পুরোপুরি ঠিক হয়নি। তারপরও কী করতে যাচ্ছেন? এক নিঃশ্বাসে অনেকগুলো কথা বলে আমার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে থাকে আফজাল। যাচ্ছি মিঠামইন কলেজে। এক্সট্রানাল হিসেবে। এ নিয়েই এতক্ষণ কথা হলো প্রিন্সিপ্যাল স্যারের সঙ্গে। ওহ তাই বলেন! ১৮ তারিখ কাজ ওখানে। ওইদিন ভাইভা বোর্ডে থাকতে হবে। সে তো অনেক দেরি। কালকেই যাচ্ছেন কেন? ভাবছি দুয়েকদিন ঘুরবো। আমিও যাবো ভাই আপনার সঙ্গে! আফজালের কথায় খুব অবাক হই না। তাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে খুব নিস্পৃহ গলায় বলি, তুমি যাবে কেন? এমনি যাবো ভাই! আমি কখনো হাওর দেখিনি। আপনার কি কোনো সমস্যা আছে আমি গেলে? যদি থাকে তো বলেন, যাবো না। কিছুটা অভিমানের সুর তার গলায়। নাহ আমার কোনো সমস্যা নেই। চলো! ঠিক আছে ভাই। আজকেই ছুটির অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে দিচ্ছি। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে ধীরে ধীরে খাওয়া শেষ করার চেষ্টা করি।
পরের দিন দুপুর বেলা আমি আর আফজাল উঠে বসি কিশোরগঞ্জের বাসে। ঢাকার জ্যাম পেরিয়ে বাস হাইওয়েতে পড়তে ঘণ্টাদেড়েক লেগে যায়। বড় রাস্তায় উঠে বাস চলতে থাকে ঝড়ের বেগে। আফজাল আমার কাঁধে মাথা রেখে অঘোরে ঘুমুচ্ছে। খোলা জানালা দিয়ে আসছে হু হু বাতাস। বাতাসে আমার মাথার চুল উড়ে উড়ে চোখে ঝাপটা মারছে। তবুও খুব ভালো লাগে। পেছনের সিটে এক তরুণ মা বসেছে তার সাড়ে তিন-চার বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে। ছেলেটা একটু পরপর সিটে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখার চেষ্টা করছে। পেছন থেকে আমার চুলে হাত দেওয়ার চেষ্টা করছে। আর ছেলেটার মা তাকে থামানোর নানা চেষ্টা করেও না পেরে এক সময় ধমক লাগায়। ছেলেটা কিছুক্ষণ চুপ মেরে থাকে। মিনিট পনেরো পর আবারও আগের মতই দুষ্টুমি করতে থাকে। এবার আমি ছেলেটাকে কাছে ডেকে নিই। রাজ্যের গল্প করতে করতে এক সময় আমার কোলেই ঘুমিয়ে যায়। ততক্ষণে আমি তার নাম জেনে নিয়েছি। আদিত্য যাচ্ছে তার বাবার কাছে। বাবা পানি উন্নয়ন বোর্ডের চাকুরে। তারা যাচ্ছে বাবার সঙ্গে দেখা করতে।
সন্ধ্যা ছোঁয়া সময়ে আমরা পৌঁছাই কিশোরগঞ্জ শহরে। আগে থেকে ঠিক করে রাখা হোটেলে উঠে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে দেখি খুব ক্লান্ত লাগছে আমার। কিন্তু আফজালের উৎসাহের সীমা নেই! এখনই হাওর দেখতে বের হয়ে যেতে চায় সে। তোমার যা মন চায় করো। আমি এখন একটু রেস্ট নেবো। আমার কথা শুনে মন খারাপ করলো কি না জানি না। তবে ঘর ছেড়ে বের হয়ে যায় সে। আমাকে যখন ঘুম থেকে ডেকে তোলে রাত তখন নয়টা। নিচেই একটা রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেয়ে পরের দিন কীভাবে মিঠামইন যাবো, জেনে নিয়ে রুমে এসে ঘুমিয়ে পড়ি।
কিশোরগঞ্জ শহর থেকে সিএনজি অটোরিকশায় আমরা যাই করিমগঞ্জ। বালিখোলা ঘাট থেকে একটা স্পিডবোট ভাড়া করে উঠে বসি দুজন। স্পিডবোট ছাড়াও সেখান থেকে ইঞ্জিন নৌকা যায় ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে। অন্যযাত্রীর সঙ্গে মিলে আমি ইঞ্জিন নৌকায় যেতে চাই। কিন্তু আফজালের কথা হলো এতে আমাদের প্রাইভেসি থাকবে না। এক-দেড় ঘণ্টার যাত্রায় প্রাইভেসির কী আছে আমার মাথায় ঢোকে না। এছাড়া আমরা যখন সবার সঙ্গে মিলে বাসে করে এসেছি, তখন প্রাইভেসির প্রশ্ন তো আসেনি। এসব কথা বলতে ইচ্ছে করে আফজালকে। কিন্তু বলি না। কারণ বলে লাভ নেই। তারচেয়ে চুপচাপ তার সঙ্গে স্পিডবোটে উঠে বসি। মনটা একটু খারাপ লাগতে শুরু করে। অল্প সময়ের মধ্যেই ঘাট ছেড়ে হাওরের বিস্তৃত জলে পড়ে আমাদের স্পিডবোট।
কী সুন্দর টলটলে জল! যেদিকে চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। বিস্তৃত জলরাশি কী অপরূপ মহিমা নিয়ে বিছিয়ে আছে হাওরের বুকজুড়ে। কোথাও কোথাও ছোট্ট দ্বীপের মতো জেগে আছে খণ্ড খণ্ড সবুজ। গরু-মহিষের দল হাওর জলে ভাসিয়ে দিয়ে ছোট ডিঙি নৌকায় করে কৃষাণ-রাখাল যাচ্ছে তাদের পাশে পাশে। অথৈ জলে দীর্ঘপথ সাঁতার কেটে গরু-মহিষেরার ঘাস খেতে যাচ্ছে। হাওরে ভাসছে অনেকগুলো ছোট ছোট ডিঙি নৌকা। মাছ মারার চেষ্টা করছে শৌখিন মাছ শিকারি। বাতাস বইছে হু হু করে। কেমন যেন মন উদাস করা পরিবেশ। একটু পর পর আসছে ইঞ্জিনের নৌকা। তার ভটভট শব্দ শোনা যায় অনেক দূর থেকে। দেখা মেলে দুয়েকটি স্পিডবোটও। শাঁ শাঁ শব্দ তুলে জল কেটে তীব্র বেগে এগিয়ে যায় এই যান্ত্রিক জলযান। ইঞ্জিন নৌকা কিংবা স্পিডবোট চলে গেলেই আবার সব সুনসান নীরব। শুধু বাতাসের আওয়াজ। আর জলের বয়ে চলার বিজবিজ শব্দ। মাথার ওপর ওড়ে জীবনানন্দের শঙ্খচিল, সাদা বক। ভাসমান জলজ উদ্ভিদ কিংবা কচুরিপানার শরীরে অলস বসে থাকে দুয়েকটা পানকৌড়ি। শ্যাওলা রং শরীরের কানিবকের দেখাও মেলে আশপাশে চোখ মেললে। কী সুন্দর! কী যে মনোরম সুন্দর সবকিছু। শহুরে গতি এই হাওরে যেন পথ হারিয়েছে। এখানে সবকিছুই অপার্থিব মন্থর সুন্দর। দেখে খুবই ভালো রাগে। মনের মাঝে পুলক নয়, কেমন যেন বিরহ জাগে। আকাশের দিকে তাকাই। কালচে মেঘে ছেয়ে আছে সব। অনেক দূরে এক কোণে ভাসে সাদা মেঘের রথ। অনেক দূরে আবছা মতো দেখা যায় সবুজ গাছ গাছালির সারি। একটাও বাড়িঘর চোখে পড়ে না।
একটু পর বৃষ্টি নামে। খুব হালকা ছাঁটের বৃষ্টি। শরীরে পড়ে বাষ্পের মতো মিলিয়ে যায় বৃষ্টি ফোঁটা। স্পিডবোট চালকের চোখে মুখে কেমন উদ্বেগ দেখি। চোখে চোখ পড়তেই তরুণ স্পিডবোট চালক বলেন, ঝড় উঠলে বড় বিপদ। আমারও কেন যেন ভয় ভয় লাগতে থাকে। সাঁতার জানি বটে। তবে সাগরের মতো বিস্তৃত হাওরে উতল উচ্ছ্বল বাঁধনহীন জলের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকার মতো যথেষ্ট সাঁতার জানি কি না বুঝতে পারি না। কিন্তু আফজালের দিকে তাকিয়ে দেখি কোনো উদ্বেগ কিংবা ভয়ের চিহ্ন নেই কোথাও। বরং ভীষণ উচ্ছ্বাসে একের পর এক ছবি তুলে চলেছে সে। কখনো ভিডিও করছে। স্পিডবোটের চলার গতিতে পানি ছিটকে ছিটকে উঠছে ভেতরে। আমাদের শরীর ভিজে যাচ্ছে। পানির বড় একটা ঝাপটা এসে পুরোপুরি ভিজিয়ে দেয় সারা মুখ, চশমার কাঁচ। তবুও খুব ভালো লাগে আমার। শরীরের অবসাদ বোধ, মনের বিষণ্নতা সব যেন উড়ে গেছে অনেক দূরে কোথাও। পঁচিশ-তিরিশ মিনিট পর ঘাটে ভেড়ে আমাদের স্পিডবোট। আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে দেখি ভীষণ স্মার্ট এক তরুণকে। পরিচয় হয় তার সঙ্গে। আশফাক হোসেন কলেজের কেমিস্ট্রির প্রভাষক। অল্পকদিন হয় জয়েন করেছেন মিঠামইন কলেজে। আশফাকের পিছু পিছু হেঁটে আমরা উঠে বসি একটা ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকে। এই এক জিনিস ব্যাটারির রিকশা এখন দখল করে নিয়েছে ঢাকার বাইরের পুরো দেশ। দেশের যে প্রান্তেই যাই, চোখে রিকশা কিংবা ভ্যান ট্যান সব উঠে গিয়ে তার দখল নিয়েছে তিন চাকার বাহনটি। ইজিবাইকে করে কলেজে পৌঁছাতে সাত-আট মিনিট সময় লাগে। আমার মনে হয় হেঁটেও আসা যেত পথটুকু।
কলেজের গেস্ট হাউজে থাকার ব্যবস্থা করা হয় আমাদের। মফস্বলের কলেজ অনুযায়ী বেশ ভালো ব্যবস্থা বলা চলে। একেবারে হাওরের কোল ঘেঁষে কলেজ। গেস্ট হাউজের জানালা দিয়ে চোখ মেললেই বিশাল হাওর। তীব্র বাতাসে হাওরের জলে হঅ হঅ মতো এক ধরনের অদ্ভুত শব্দ কানে আসে। হাওরের জল লালচে মেটে রঙের। অনেকটা পদ্মার পানির মতোর রং। একটু ফ্রেশ হয়ে আমি যাই প্রিন্সিপ্যালের সঙ্গে দেখা করতে। আফজালকে দেখি শার্ট বদলে একটা রংচঙা টি-শার্ট পরে মাথায় বাহারি ক্যাপ চাপিয়ে কোথায় যেন চলছে। জিজ্ঞেস করি, কোথায় যাও আফজাল? একটু ঘুরেফিরে এলাকাটা দেখি। আপনি আপনার কাজ সারেন ভাই। কলেজের অধ্যক্ষ রফিক সাহেব বেশ অমায়িক মানুষ। সারাক্ষণ মুখে হাসি লেগেই আছে। রিটায়ারমেন্টের খুব বেশি দেরি নেই। তবুও প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর। তার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগে। প্রিন্সিপ্যালের রুমে বসেও বুঝতে পারি বাইরের বারান্দায় শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়েছে। হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে এক্সট্রানাল হিসেবে যিনি এসেছেন তিনি লোকটা কেমন!
অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের রুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় দাঁড়ালে সামনে কলেজের বিশাল মাঠ। সবুজ ঘাসের গালিচা চোখে অন্যরকম আরাম দেয়। মাঠের অপর প্রান্তে বেশ কয়েকটা ঝাঁকড়া গাছ। অতদূর থেকে চিনতে পারি না কী গাছ সেগুলো। গাছের বাঁধানো গুঁড়িতে ছেলেমেয়ের দল বসে আছে। পাশেই ঝালমুড়ি, আমড়া, আচারওলায়ার উপস্থিতিও চোখে পড়ে। আকাশে রোদের তেজ মরে আসছে। সেই সঙ্গে বাতাস আছে প্রচুর। ফলে খুব একটা গরম লাগে না। থাকার জায়গায় ফিরে দুপুরের খাবার খাই। বেশ ভালো রান্না। হরেক পদের মাছের সঙ্গে মুরগির ঝাল ভুনা আর ডাল। আফজালকে দেখি না কোথাও। ইচ্ছে করেই ফোন দিই না। ঘুরুক মনের আনন্দে। খাওয়া শেষে বিছানায় শুই একটু।
ঘুম ভাঙে আফজালের ডাকে। সন্ধ্যা মিলিয়েছে বেশ আগে। প্রথমে বুঝতে কিছুটা সময় লাগে, কোথায় আছি, কী করছি। পরক্ষণেই হুঁশ আসে। আমরা আছি মিঠামইন কলেজের গেস্ট হাউজে। আমি আর আফজাল আজ সকালে এসেছি এখানে। আফজাল ঘুরতে বের হয়েছিল। আর আমি দুপুরের পর ভাতঘুমে কাবু হয়ে এখন আফজালের ডাকে উঠে বসেছি! ভাই, কী ভাবছেন অতো? কই নাহ, কিছু না! সারাক্ষণ যে কী ধ্যানে থাকেন, আপনিই জানেন। ভাই জীবনটা এনজয় করার চেষ্টা করেন। আপনি তো ভেবে ভেবেই এক জীবন কাটিয়ে দেবেন। আফজাল অল্প কথায় কিছু বলতে পারে না। যাই বলবে বিশাল বিস্তৃত বর্ণনা দিয়ে বলতে হয় তার। এখন অতো কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না। না হলে তাকে জিজ্ঞেস করতাম, সারাদিনে কোথায় কোথায় ঘুরলো, আর কী দেখলো! আমাকে কোনো কথা বলতে হয় না। নীরবতা ভাঙার দায়িত্ব আফজালই নেয়। ভাই দেখেন, কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি আসলেই খুব সুন্দর চাঁদ কালচে মেঘের ফাঁকে রুপালি আভা নিয়ে ঝুলে আছে আকাশে। পাভেল ভাই, চলেন বাইরে যাই। আফজালের গলায় চাঞ্চল্য! চলো।
গুটি গুটি পায়ে হেঁটে দুজন গিয়ে বসি হাওরের পাড়ে। শান বাঁধানো সড়কের পাশে একটু পর পর ইট সিমেন্ট দিয়ে বানানো টাইলসওয়ালা বেঞ্চ। আমরা দুজন বসি। জোছনায় ভেসে যাচ্ছে প্রান্তর। হাওর জলে ঝিলিক দেয় জোছনার আভা। যেন মধ্যদুপুরের রুপালি আলোয় চকচক করছে জল। বাতাস বইতে থাকে উদ্দাম উচ্ছ্বল। কাছে দূরে অনেক জায়গায় ছোট ছোট আলো দেখতে পাই। রাতের অন্ধকারে লম্বা বাঁশের ডগায় কুপি বেঁধে লোহার চিকন শলা দিয়ে বানানো কোচ দিয়ে মাছ ধরছে মানুষ। এভাবে মাছ ধরাকে স্থানীয় ভাষায় বলে ‘আলোই মারা’। আমি একটা সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করি। তীব্র বাতাসে বারবার নিভে যায় আগুন। আফজাল বাঁধা দেয়। ভাই মাত্র অসুখ থেকে উঠেছেন। সিগারেটটা একটু কম খান। এমন সুন্দর পরিবেশে সিগারেট না খেয়ে আকাশ দেখেন ভাই। প্রকৃতি দেখেন। আফজালের কথামতো হাতের সিগারেট ফেলে দিই। চোখ বাড়াই সামনের জলভরা প্রান্তরে। খুব দূর থেকে ভেসে আসে গানের সুর- একলা থাকার রাত দুপুরে বন্ধু তুই কই? তোর জন্য সাজাইয়াছি ময়ূরপঙ্খি নায়। আমার সকাল দুপুর রাত, তোর বিরহে যায়! হঠাৎ গানের সুরে বুকের ভেতর কোথায় যেন প্রচণ্ড ধাক্কা লাগে। মন কেমন করতে থাকে আমার। অনেক বছর পর খুব করে রাইয়ের কথা মনে পড়তে থাকে। আকাশের দিকে তাকাই। অসংখ্য তারার মেলা। আমার মনে পড়ে, রাই খুব তারা ভালোবাসতো! আফজালের দিকে তাকাই। দেখি তার চোখ ছলোছলো। একটু আগে আমাকে সিগারেট ধরাতে মানা করেছিল। এখন সে আমাকে বলে, একটা সিগারেট দেন তো পাভেল ভাই। সিগারেট জ্বালিয়ে খুব করে কাশতে থাকে আফজাল। তোমার মন খারাপ? আস্তে করে জিজ্ঞেস করি। আমার কেউ নাই ভাই। বলেই হু হু করে কাঁদতে থাকে।
আমি আর কোনো কথা বলি না। তাকে কান্নার সুযোগ দিতে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াই। আর মনে মনে বলি, আমাদের কেউ নেই!