খান মুহাম্মদ রুমেল
সরব উপস্থিতি জানান দিয়ে দেশে আসা ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রাক নির্বাচনী প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ ছাড়ে ২৩ জুলাই ২০২৩। ১৫ দিনের বাংলাদেশ সফরে তারা বৈঠক করে ৭৫টি। সফর করে ঢাকার বাইরেও। কিন্তু ১৫ দিনের সফরে কী দেখলেন, কী বুঝলেন—গণমাধ্যমে বলেননি কিছুই। আলোড়ন তোলা মিশন শেষে নীরবে চলে গেলেন তারা।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রচুর আলোড়ন এবং আলোচনা তুলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক নির্বাচনী প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসে ৯ জুলাই ২০২৩। ছয় সদস্যের প্রতিনিধি দল এসেই বৈঠক করে পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, আইন ও বিচার, তথ্য ও সম্প্রচার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের সঙ্গে।
বৈঠক করে রাষ্ট্রের সবোর্চ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেলসহ বিচার অঙ্গনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও। এছাড়া আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারানো জামায়াতে ইসলাম এবং নিবন্ধন না পাওয়া এবি পার্টি ও সম্প্রতি নানা কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা সমালোচনার তুঙ্গে থাকা গণ অধিকার পরিষদের সঙ্গেও কথা বলে তারা।
বৈঠক করে নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ, সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যমের শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে। ঢাকার বাইরে সিলেটেও যায় তারা। শোনা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা পরিদর্শনের আগ্রহ ছিল তাদের। কিন্তু সরকারি অনুমতি না মেলায় হয়নি সেই সফর।
এছাড়া বিভিন্ন সময় র্যাব পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কথা বলেন তারা। ২৩ জুলাই বাংলাদেশ ছাড়ার আগে যে ক’দিন এখানে অবস্থান করেছে, প্রতিদিনই নাওয়া খাওয়া ভুলে সকাল-সন্ধ্যা কাটিয়েছে ব্যস্ত সময়। ১৫ দিন ধরে তারা বুঝতে চেষ্টা করেছেন, এখানকার রাজনৈতিক পরিবেশ, আসছে নির্বাচনের সময় পরিস্থিতি কেমন থাকতে পারে ইত্যাদি নানা বিষয়।
…১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হয়ে গেলেন। নির্বাচন নিয়ে কোনো আইনি জটিলতা হলো না ঠিকই। কিন্তু নৈতিকতার মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল।
বাংলাদেশে অবস্থান কালে প্রদীপের আলোয় থেকেছেন পুরোটা সময়। গণমানুষেরও তাদের নিয়ে ছিল ব্যাপক আগ্রহ। ফলে গণমাধ্যমও ছুটে বেরিয়েছে তাদের পেছনে। তাদের দীর্ঘ সফরের মাঝেই সংক্ষিপ্ত সফর করে গেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া। সবাই মোটামুটি আগামী জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্র করেই বাংলাদেশ সফর করেছেন বলে গণমাধ্যমগুলো বলতে চাইছে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সফরে এলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ইমন গিলমোর। তিনি সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। দেখা করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গেও। সব বৈঠক শেষে গণমাধ্যমে বলা তার বক্তব্যের সারমর্ম হলো—আগামী নির্বাচন কেন্দ্র করে এখানে গণতন্ত্রের চর্চা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ আছে বলে তিনি মনে করেন।
এ তো গেল বিদেশিদের সফর এবং পর্যবেক্ষণ বিষয়ক কথা। কিন্তু আসল কথা হলো তারা আসছেন কেন? কেন কথা বলছেন? কেন প্রশ্ন তুলছেন? বিএনপি আছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে একদফার আন্দোলনে। সরকারি দল আওয়ামী লীগ আছে সুষ্ঠু নির্বাচনের একদফার ঘোষণায়। শেষ পর্যন্ত কোথাকার জল কোথায় গিয়ে গড়ায় তা সময় বলে দেবে।
বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ বলছে, আন্দোলনের নামে আগুন সন্ত্রাস করা দল। আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ্য করে বিএনপি বলছে, মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে জোর করে ক্ষমতায় থাকা দল এবং দুই দলই একে অপরের বিরুদ্ধে নানা যুক্তি তথ্য তুলে ধরছে। কখনো আবার ঢালাও অভিযোগ করে যাচ্ছে।
এসবের মধ্যে কতটুকু সত্য আর কতটুকু মিথ্যা তা জনগণ বিচার করবে। কিন্তু তাদের এই কথার পাল্টাপাল্টি এবং ক্ষেত্রবিশেষে বল প্রয়োগের রাজনীতির কারণে গণতন্ত্র কি সঠিক পথে চলছে? নাকি বয়ে চলা নদীর জল যেমন কখনো কখনো অনভিপ্রেত বাধা বেয়ে থমকে যায়, সেই অবস্থায় আছে? প্রশ্নের মীমাংসা এত সহজ নয়।
২০১৪ সালে নির্বাচন ঠেকানোর নামে বিএনপি জামায়াত জোট আগুন সন্ত্রাস করল। দেশজুড়ে জ্বালাও পোড়াও করল। ভোট কেন্দ্র পোড়াল। নির্বাচনী কাজে যুক্ত কর্মকর্তাদের আহত নিহত করল।
আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপি চেয়ারপার্সনকে বালির ট্রাক দিয়ে গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখল। সবশেষ একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হয়ে গেলেন।
নির্বাচন নিয়ে কোনো আইনি জটিলতা হলো না ঠিকই। কিন্তু নৈতিকতার মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। এই অবস্থায় আন্দোলনের হালে পানি না পেয়ে মাঠ ছেড়ে ঘরে ঢুকে গেল বিএনপি।
…নির্বাচন সামনে রেখে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলি আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা অন্য যার কথাই বলি না কেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাদের নাক গলানোর সুযোগটা আসলে তৈরি করে দিচ্ছে কে?
২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি এলো হায়ার করে আনা নেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে। নিবন্ধন হারানো জামায়াতকে দিলো নিজেদের প্রতীক ধানের শীষ। কিন্তু তারপরেও তাদের মাত্র ছয়টি আসনে জয়ী হওয়াকে কেউই স্বাভাবিক বলে মানেননি। বিএনপি তো নয়ই। এমনকি সরকারি দলের নেতারাও জোর গলায় বলতে পারেন না ২০১৮ সালে একটি ভালো নির্বাচন হয়েছে।
সুতরাং আরেকটি নির্বাচন সামনে রেখে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলি আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা অন্য যার কথাই বলি না কেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাদের নাক গলানোর সুযোগটা আসলে তৈরি করে দিচ্ছে কে?
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করল বীর বাঙালি। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধানতম চেতনাই ছিল গণতন্ত্র। তারপর চার বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে রুদ্ধ করা হলো গণতন্ত্রের পথ। সামরিক স্বৈরশাসন চেপে বসল বাংলাদেশের বুকে।
নব্বইয়ে সব রাজনৈতিক দল মিলে দীর্ঘ গণআন্দোলনে স্বৈরাচার হটালো। একানব্বইয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পথে হাঁটা শুরু করল বাংলাদেশ। এর তিন দশক পেরিয়ে এসে এখনো কেন প্রশ্ন। এই বাদানুবাদ তৈরি করল কারা?
বাংলাদেশের মানুষ কিন্তু বরাবরই আস্থা রাখে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। গণতন্ত্রের জন্যই বুকে পিঠে গুলি নিয়েছে বাংলাদেশের অগুনতি তরুণ। সুতরাং লাখো শহীদের রক্তস্নাত বাংলাদেশে শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রই জয়ী হবে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
সময় বয়ে গেছে অনেক। যাচ্ছে আরও। তবে সময় এখনো পেরিয়ে যায়নি। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সমস্বরে, সমান অংশীদারিত্বে এগিয়ে নেবে গণতন্ত্রের মশাল সেই আশায় দেশের কোটি মানুষ।
খান মুহাম্মদ রুমেল ।। অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর, সময় টিভি