নঈম নিজাম
ঈদের দুই দিন আগে শেষ অফিস ছিল আমাদের। সহকর্মী শামছুল হক রাসেল ছুটে এলো রুমে। বলল, দাদা কথা বলবেন। ফোনটা ধরতেই ভরাট গলায় বললেন, ২ মে ঢাকা আসছি।
ঢাকা ক্লাব গেস্টহাউসে বলে রাখুন। জবাবে বললাম কোনো সমস্যা নেই। ঢাকা ক্লাবে আমারও বলার দরকার নেই। রাসেলকে বলা আছে।
আপনি যখনই আসবেন রাসেল সব ঠিক করে রাখবে। কয় তারিখ আসবেন? তিনি বললেন, অনেক দিন আসা হয় না। ২ মে ঢাকা আসবই। হঠাৎ মনে হলো দেশের বাইরে থাকব।
দাদা ঢাকা এলে দেখা হবে না এটা কেমন হয়? তাই বললাম, দাদা ৮ তারিখ আসুন না। ২৫ এপ্রিল দেশের বাইরে যাব। ৮ মে ফিরব। আমার জন্য সুবিধা হয়। তিনি বললেন, ঠিক আছে ২ তারিখ এলে ১২ মে পর্যন্ত থাকব।এবার বললাম, তাহলে ঠিক আছে। আপনার সঙ্গে ৯ তারিখ দেখা হবে। ঈদের পর অফিস খুলল। তিনি জানালেন ঢাকা আসার তারিখ পরিবর্তন করেছেন। ৮ মে আসবেন। খুশি হলাম। বললাম, আরও বেশি ভালো হলো।
২৫ এপ্রিল চলে গেলাম দেশের বাইরে। সেখানে থাকতে খবর পেলাম সমরেশদা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। হাসপাতাল থেকেই চিকিৎসকদের অধীনে ফুরফুরে মেজাজে আছেন। তিনি ধারণা করছেন সুস্থ হয়ে উঠবেন। তাই ঢাকা সফর বাতিল করেননি। করোনাকাল থেকে আটকে আছেন কলকাতায়। তাই ঢাকা তাঁকে টানছে। এতদিন আসতে পারেননি চিকিৎসকের নিষেধাজ্ঞায়। অনেক দিন থেকে শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না বিখ্যাত লেখক সমরেশ মজুমদারের। উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ, সাতকাহনসহ বিখ্যাত সব বইয়ের লেখক। আমাকেও একটি বই উৎসর্গ করেছেন। নাম ‘অনুপ্রবেশ’। সমরেশদার সঙ্গে সম্পর্কটা অনেক দিনের। কখন কীভাবে আমরা ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম বলা মুশকিল। তবে বলতে পারি তিনি আমাকে পছন্দ করতেন। ঢাকা এলে ছুটে আসতেন বাংলাদেশ প্রতিদিন অফিসে। নিয়মিত লিখতেন আমার সম্পাদিত কাগজে। ঢাকা শহরে তাঁর মতো অতিথিকে বারবার রাখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। তিনি মিশে গিয়েছিলেন বাংলাদেশ প্রতিদিন পরিবারে। পত্রিকাটিকে তিনি নিজের করে নিয়েছিলেন।
পাঁচ-ছয় বছর আগের কথা। একবার ছিলাম আমেরিকায়। ঢাকার দুপুর, ওখানে মধ্যরাতে তিনি ফোন করলেন। বললেন, আমি আপনার অফিসে। বললাম, দাদা আমি তো আমেরিকায়। জবাবে বললেন, জানি। তুমি নেই। তোমার অফিস আছে। ভাবলাম, অফিসে ঘুরে যাই। এখন সবার সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি। বসেছি, তোমার রুমে। মনটা ভরে গেল প্রবাসে বসে। ধন্যবাদ দিতেই তিনি বললেন, তোমার সঙ্গে তো ধন্যবাদের সম্পর্ক না।
দাদা এমনই ছিলেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনে নিয়মিত লিখেছেন। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, ঈদ সংখ্যায় তাঁর লেখা না থাকলে চলতই না। একবার ঢাকা এলেন কারও একটা অনুষ্ঠানে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সেøাগান কী হবে সেই ভাবনায় খুব চিন্তিত ছিলাম। তিনি আমার টেবিলের সামনে বসা। একটা কাগজ হাতে নিলেন। বললেন, কততম প্রতিষ্ঠবার্ষিকী? বললাম, সাত। তিনি হাতে লিখলেন, সাতে সমুদ্র। তারপর বললেন, সমুদ্রের মতো গর্জন তুলে মাত্র সাত বছরে পত্রিকাটি বিশালত্ব নিয়েছে। দেশের শীর্ষ দৈনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এবার সেøাগান হোক- ‘সাতে সমুদ্র’। আরেকবার তাঁকে ফোন করলাম কলকাতায়। বললাম, দাদা পত্রিকার এবারকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আপনাকে সংবর্ধনা দেব। তিনি হাসলেন। বললেন, আমি তো এই পত্রিকার সদস্য। বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সংবর্ধনা দিলেও আসব। না দিলেও আসব। তিনি এলেন।
আরেকবার সমরেশ মজুমদার আমার রুমে বসে জম্পেশ আড্ডা দিচ্ছেন। আড্ডার টেবিলে সেদিন ইমদাদুল হক মিলনও ছিলেন। তিনি ঢাকার একটি বড় কাগজের নাম নিয়ে বললেন, তারা আমার কাছে লেখা চেয়েছে। তাদের প্রশ্ন করলাম, তোমাদের কাগজের সম্পাদক হিসেবে কি নঈম নিজাম যোগ দিয়েছে? জবাবে তারা প্রশ্নবোধক চোখ নিয়ে তাকিয়ে থতমত খেল। তারপর বলল, দাদা এ কথা কেন বলছেন? জবাবে তাদের তিনি বললেন, আমি তো নঈমের জন্য ঢাকার কাগজে লিখি। তাকে ছাড়া অন্য পত্রিকায় লেখা দিই না। দিলেও তাকে জানিয়ে রাখি। সঙ্গে সঙ্গে বললাম, দাদা আমি কিন্তু কাউকে লেখা দিতে বারণ করিনি। লেখকের যেখানে মন চাইবে লিখবে। তিনি বললেন, তুমি বারণ করনি ঠিকই। তবে সবার জন্য লিখতে ভালো লাগে না। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে লেখালেখিতে এসেছি। বন্ধুদের জন্যই লিখি। ঢাকার পত্রিকায় লেখা শুধু তোমার। ইমদাদুল হক মিলন পাশ থেকে বললেন, আমি লেখা চাইলে তুমি দেবে না? জবাবে সমরেশ মজুমদার বললেন, না, তুমি চাইলেও দেব না। বিস্ময় নিয়ে তাকালেন ইমদাদুল হক মিলন। এতদিনের ঘনিষ্ঠতার পরও এই জবাব তিনি হয়তো আশা করেননি।
সমরেশ মজুমদার এমনই ছিলেন। সোজাসাপ্টা কথা বলতেন। তিন দশক থেকে তাঁর সঙ্গে চলেছি। ঘুরেছি নিউইয়র্কের হাডসন নদীর তীর থেকে নরসিংদীর মেঘনার বুকে। তাঁর মাঝে কোনো দিন পরিবর্তন দেখিনি। সব সময় একরকম ছিলেন। নরসিংদীর প্রবীণ রাজনীতিক রাজু ভাইয়ের সঙ্গে একদা গভীর বন্ধুত্ব ছিল। ২০০৮ সালে রাজু ভাই মন্ত্রী হওয়ার পর সমরেশদা ঢাকা এলে আর রাজু ভাইকে খবর দিতে চাইতেন না। অনেক সময় বলতাম, রাজু ভাইকে খবর দিই? জবাবে বলতেন, রাজু এখন মন্ত্রী। ক্ষমতা থেকে দূরে থাকি। ক্ষমতার কাছে যেতে হয় না। মনে পড়ছে, ২০০৭ সালে রাজু ভাই ও ভাবি আমাদের নিয়ে গেলেন নরসিংদীর রায়পুরার আদিয়াবাদে। তখন দেশে ওয়ান-ইলেভেন টাইম। রাজনীতির হইচই নেই। রাজু ভাইয়ের আদিয়াবাদ কলেজের একটি অনুষ্ঠানে সমরেশদা অংশ নিলেন। সঙ্গে আমি ও ফরিদা ইয়াসমিন, ম. হামিদ ও ফাল্গুনী হামিদ। রাজু ভাইয়ের গ্রামের বাড়িতে আড্ডা দিয়ে দুপুরে ফিরলাম শহরে। একটি বাড়িতে খেলাম আমরা। তারপর মেঘনায় নৌকায় ঘুরে বেড়ালাম। সন্ধ্যার পর ফিরলাম ঢাকায়। সেই রাজু ভাই থেকে সমরেশদা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে পছন্দ করতেন সমরেশ মজুমদার। বলতেন, তোমাদের প্রধানমন্ত্রী অনেক বই পড়েন। ১৯৯৪ অথবা ’৯৫ সালের কথা। সমরেশ মজুমদার ঢাকায় এলেন। শেখ হাসিনা নিমন্ত্রণ জানালেন তাঁকে। তিনি গেলেন। কথায় কথায় সমরেশ মজুমদার জানলেন শেখ হাসিনা তাঁর লেখা উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ, গর্ভধারিণী, সাতকাহনসহ অনেক বই পড়েছেন। শুধু পড়েননি, চরিত্রগুলোও শেখ হাসিনার মুখস্থ।
খাবার টেবিলে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে সমরেশ মজুমদার বললেন, আমি আনন্দিত বাংলাদেশের আগামী দিনের প্রধানমন্ত্রী আমার লেখা পড়েন। শেখ হাসিনা তখন সাতকাহনের দীপাবলী চরিত্রের শুরু ও সমাপনী নিয়ে কথা বললেন। সমরেশদা বললেন, আগামী দিনের প্রধানমন্ত্রীর সামনে আছি। আপনি ক্ষমতায় এলে লেখক সমরেশ মজুমদার যা চাইবে আশা করি তা পাবে। সমরেশ মজুমদারের দুষ্টামির জবাবে শেখ হাসিনা বললেন, লেখক যা চাইবে তাই দেব। সমরেশ মজুমদার বললেন, এভাবে বললে হবে না। সাদা কাগজে লিখে দিন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী কাগজ-কলম নিলেন। বললেন, এবার বলুন কী লিখতে হবে? সমরেশ মজুমদার বললেন, এবার লিখুন আমি ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশে প্রবেশে লেখক সমরেশ মজুমদারের ভিসা লাগবে না। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী মজা করে লেখাটি লিখলেন। সমরেশ মজুমদার সেই কাগজটি সঙ্গে নিলেন। তারপর অনেক দিন যত্ন করে তা রেখে দিলেন। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এলো আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা হলেন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। সেই কাগজটি সঙ্গে নিয়ে ঢাকা এলেন সমরেশ মজুমদার।
বিমানবন্দরে সমরেশ মজুমদার পাসপোর্ট না দিয়ে কাগজটি এগিয়ে দিলেন। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা লেখক সমরেশ মজুমদারকে চেনেন। ঘেমে উঠলেন তিনি। ছুটে এলেন বড় কর্মকর্তা। কাগজটি হাতে নিয়ে হাসলেন। বললেন, দাদা আমিও আপনার ভক্ত। বেড়ে উঠেছি অনিমেষ হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। হয়েছি পুলিশ অফিসার। বাইরে আপনাকে যাঁরা নিতে এসেছেন তাঁরা অপেক্ষা করছেন। সমরেশদা এবার পাসপোর্ট এগিয়ে দিলেন। অনেক বছর তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর লেখাটি সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। জানি না তাঁর মেয়ের কাছে এখন এই কাগজটি আছে কি না। সমরেশদা এ নিয়ে অনেক গল্প করতেন। হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইতিবাচক অবস্থানের প্রশংসা করে বলেছিলেন, তোমরা সৌভাগ্যবান। খোদ প্রধানমন্ত্রী একজন অসুস্থ লেখকের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমেরিকার মতো দেশে চিকিৎসার জন্য অবস্থান করতে পারেন সেই ব্যবস্থা নিয়েছেন। এ যুগে এমন প্রধানমন্ত্রী পাওয়া কঠিন।
সমরেশ মজুমদার সোজাসাপ্টা কথা বলতেন। তিনি প্যাঁচানো ছিলেন না। যা ভালো মনে করতেন বলতেন। তাঁর মুখে অন্য কারও বদনাম শুনিনি। কাউকে ঈর্ষা করতে দেখিনি। মজা করে গল্প জমাতেন। মিশে যেতেন সবার সঙ্গে। ঢাকা ক্লাবের সাধারণ স্টাফরা তাঁকে পছন্দ করতেন। তারা জানতেন সকালে তিনি কী খাবেন। রুম থেকে নেমে ব্রেকফাস্ট টেবিলে তিনি দেখতেন খাবার তৈরি। চারপাশ জয় করে মহারাজার মতো চলতেন একজন সমরেশ মজুমদার। সবাইকে আপন করে নিতেন মুহূর্তে। ছোট বড় কোনো ব্যাপার ছিল না। আমাদের অফিসের ড্রাইভাররা তাঁকে নামাতে-ওঠাতে গেলে তাদের সঙ্গেও কথা বলতেন। কোনো ভণিতা ছিল না। সাতপাঁচ ছিল না। বিশালত্ব দেখাতেন না। করতেন না নিজেকে জাহির। শুধু শরীর নয়, মনের দিক থেকেও ছিলেন বিশাল হৃদয়ের অধিকারী। তাঁর একটা দর্শন ছিল। তিনি মানুষের কথা বলতেন। মানুষের কথা ভাবতেন। তাঁর লেখনীতে সমাজের বৈষম্যের কথা উঠে আসত। নকশাল আন্দোলনের যুগটা ছিল। কট্টর ধারার আদর্শকে বেছে নিয়ে ক্ষয়ে যাওয়া তারুণ্য তুলে এনেছেন।
লেখালেখি তিনি আয়োজন করে শুরু করেননি। জীবনের প্রথম লেখার জন্য ১৫ টাকা বিল পেয়েছিলেন। বন্ধুরা হইচই করে কফি হাউসে গেলেন। সেই টাকা বন্ধুরা খরচ করলেন। সবাই বললেন, তুই আবার লিখ। লিখলে টাকা পাবি। আমরা সবাই কফি খাব। তিনি বন্ধুদের খুশি করতে আবার লিখলেন। বন্ধুরাসহ আবার হলো আড্ডা। বিল পেয়েছিলেন সে সময় ৫০ টাকা। খরচ করলেন ২৫ টাকা। দুষ্টামি করে বলতেন, কফির খরচ মেটাতে আমার লেখালেখি শুরু। তারপর লিখে গেছেন। প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’ প্রকাশিত হয় দেশ পত্রিকায়। তারপর আর থেমে থাকতে হয়নি। সমরেশ মজুমদারের একটা উপন্যাসের নাম ‘এখনো সময় আছে’। এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন লেখকের। এই লেখক সমুদ্রের ধারে একটি বাংলো কিনে একাকী জীবনে চলে গেলেন একদিন। চারপাশে ছিল সুনসান নীরবতা। কোনো হোটেল ও আবাসিক ব্যবস্থা ছিল না। এক রাতে একটি মেয়ে লেখকের বাংলোয় এসে আশ্রয় চাইল। লেখক তার নাম জানতে চাইলেন। মেয়েটি বলল, ‘আমি এখন যে নামই বলব আপনি তা বিশ্বাস করবেন। আপনার তা না মেনে কোনো উপায় নেই। ঠিকানা জানতে চাইলে বলল, আমাকে থাকতে দিন। আমার অতীত কেন টানছেন?’ এই দুনিয়াতে আমরা অহেতুক অতীত বর্তমানকে টেনে আনি। ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াতে অতি অল্প সময়ের জন্য মানুষের আগমন। প্রকৃতির প্রয়োজনে মানুষ তার মতো করে একটা জীবন পায়। তারপর সবকিছু শেষ হয়ে যায়। সমরেশ মজুমদার শেষবারের মতো বলেছিলেন, ঢাকা আসবেন। আসতে পারেননি। তার আগেই চলে গেছেন। একজন মানুষ আমাদের মাঝে ছিলেন। এখন নেই। এখন সবকিছু শুধুই স্মৃতি।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন
সূত্র ঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন